সাংবাদিক ঝর্ণা রায় তাঁর স্বামী ও পাঁচ বছর বয়সী মেয়েকে নিয়ে খাচ্ছিলেন। এক ব্যক্তি পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ‘মাথায় কাপড় না দিয়ে বেহায়ার মতো রাস্তার পাশে বসে খাচ্ছে, লজ্জা শরম নেই’ বলতে বলতে চলে যান।
ঝর্ণা রায় ফেসবুকের এক পোস্টে এ কথা উল্লেখ করে লিখেছেন, ‘মাথায় কাপড় না দেওয়ায় যা বললেন, তা নাহয় আর না–ই বললাম। কী খাব চোখ থেকে ঝরঝর করে জল গড়িয়ে পড়ছিল খাবারে।’ গত ২৯ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যার দিকে রাজধানীর ওয়ারীতে এ ঘটনা ঘটে।
সোমবার ঝর্ণা রায় প্রথম আলোকে বলেন, ‘আগেও এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে। তবে আগে প্রতিবাদ করতাম। এখন প্রতিবাদ করতেও ভয় লাগে। আমার ফেসবুকের পোস্টেই সরকারি এক কর্মকর্তা বাজে মন্তব্য করার সাহস পেয়েছেন, যা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছি না। নারীদের অবমাননা করার বিষয়ে একটি মহলের কেমন যেন সাহস বেড়ে গেছে বলে মনে হচ্ছে।’
কয়েক দিন আগেই মাইশা মাহজাবীন ফেসবুকে শুধু নারীদের কাছে প্রশ্ন রেখেছিলেন, রাস্তায় ‘ক্যাটকলিং’ (বাজে মন্তব্য) বেড়েছে কি না। তাঁর সেই পোস্টে নারীরা নিজেদের অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে বলছেন, তাঁরাও পোশাকসহ বিভিন্ন কারণে নাজেহাল হয়েছেন এবং এ ধরনের ঘটনাগুলো বেড়েছে বলেই তাঁদের মনে হচ্ছে।
লামিসা জামান নামের একজন ফেসবুকে লিখেছেন, তিনি শাড়ি পরে বের হয়েছিলেন। পেটের কিছু অংশ দেখা যাওয়ায় কয়েকজন মানুষ তুই করে সম্বোধন করে ঠিকমতো শাড়ি পরতে উপদেশ দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, আগে তিনি ভোরে বের হতে পছন্দ করতেন, আর এ ঘটনার পর সকাল সাড়ে ছয়টার দিকেও ঘর থেকে বের হতে তিনি ভয় পাচ্ছেন।
দেশে এ ধরনের ঘটনাগুলো থামছে না। বিভিন্ন সময়ে এ ধরনের নানা ঘটনা ঘটে চলেছে। শুধু ঝর্ণা রায় বা লামিসা জামান নন, চিত্রশিল্পী, শিক্ষক, নারী উদ্যোক্তাসহ বিভিন্ন পেশার নারী ওড়না নেই কেন, টিপ দিয়েছে কেন, চুল ছোট কেন—এমন নানা প্রশ্নের সম্মুখীন হচ্ছেন। এর কারণ হিসেবে কেউ কেউ বলছেন সামাজিকীকরণের অভাব, কেউ বলছেন পরিবার থেকে নারীকে সম্মান দেওয়ার শিক্ষা না পাওয়া, কেউ বলছেন ধর্মের সঠিক চর্চা না হওয়া। এ নিয়ে ফেসবুকে আরও নানা ধরনের কারণ তুলে ধরছেন অনেকে।
সমাজবিজ্ঞানীসহ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ ধরনের ঘটনা বেড়ে গেছে, তা বলার মতো সময় আসেনি। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় এসেছে। রাজনীতি, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিসহ সার্বিকভাবে দেশ একটি নাজুক পরিস্থিতিতে আছে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেই কিছু অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটানোর চেষ্টা চালায় একটি মহল।
গত বুধবার শায়লা বিথী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার পোশাক বা আমার স্বামীর রাজনীতির কারণে আমার ওপর এ হামলা হতে পারে। তবে কোনো কারণেই তো কেউ এভাবে হামলা করতে পারে না। আমি থানায় অভিযোগ করেছি, এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো অগ্রগতি হয়েছে বলে আমাকে জানানো হয়নি।’
ঢাকাসহ বিভিন্ন জায়গায় এ ধরনের ঘটনা ঘটছে, তা গণমাধ্যমেও আসছে। তবে অন্তর্বর্তী সরকারের মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা শারমিন মুরশিদ এমন ঘটনা এখন বেড়েছে, তা বলতে নারাজ। তাঁর মতে, নতুন সরকার দেশ সংস্কারের কাজে নেমেছে। একটি মহল রাজনৈতিক কারণেই প্রমাণ করতে চাইছে দেশে উগ্রবাদ বেড়ে গেছে। নারীদের ওপর এ ধরনের নির্যাতনও সে চিন্তা থেকেই ঘটানো হচ্ছে।
সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক এ বি এম নাজমুস সাকিবের মতে, ছাত্র-জনতার গণ–অভ্যুত্থানের পর নতুন সরকারের প্রতি মানুষের প্রত্যাশা বেড়ে গেছে। ফেসবুকসহ বিভিন্ন জায়গায় নারীরা হেনস্তার বিষয়গুলো প্রকাশ করছেন প্রতিকারের জন্য। এ ধরনের ঘটনা আগেও ঘটেছে।
নারীদের হেনস্তা করার ঘটনাগুলো কেন ঘটছে, এ প্রসঙ্গে এ বি এম নাজমুস সাকিব প্রথম আলোকে বলেন, সামাজিকীকরণের অভাব, সঠিকভাবে ধর্মের চর্চা না করা, বর্তমানের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এবং পরিবারসহ সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোর নাজুক অবস্থাসহ বিভিন্ন কারণেই ঘটনাগুলো ঘটছে। ফলে মনমানসিকতার পরিবর্তনসহ সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে সংস্কার করতে হবে। সচেতনতা বাড়াতে সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে।
এ ধরনের ঘটনা প্রতিরোধে বিভিন্ন স্থানে পুলিশের নজরদারি বাড়াতে হবে বলে মনে করেন ঢাকা বিভাগের জ্যেষ্ঠ সহকারী কমিশনার আরাফাত মোহাম্মদ নোমান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ধর্মভিত্তিক দলগুলোর সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। আর দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় লিঙ্গবিষয়ক অধ্যয়ন প্রাথমিক স্তর থেকে পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
সার্বিক বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা শারমিন মুরশিদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘রাস্তাঘাটে, ফেসবুকে বা অনলাইনে যেভাবে নারীদের হেনস্তা করা হচ্ছে, তা আমাকেও তাড়া দিচ্ছে। নেতৃত্বে থাকা নারীরাও এসব থেকে রেহাই পান না। এ ধরনের ঘটনা বা নোংরামি সব সরকারের আমলেই ঘটেছে। কোনো সরকারই তা শক্ত হাতে ধরেনি। এসব প্রতিরোধে আমি শক্তভাবে উদ্যোগ নেব।’ তিনি বলেন, ‘আমার মন্ত্রণালয়সহ ধর্ম, স্বরাষ্ট্র, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর সঙ্গে বসে আলোচনা করে এমন ঘটনা প্রতিরোধে একটি নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে।’