আন্তর্জাতিক নয় অভ্যন্তরীণ কারণেই জেঁকে বসেছে মূল্যস্ফীতি

দেশে দুই বছরের বেশি সময় ধরে ঊর্ধ্বমুখী মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে। এর আগে নিত্যপণ্যের বাজারে এ মাত্রার ঊর্ধ্বমুখিতা এত দীর্ঘ সময় বিরাজ করতে দেখা যায়নি। দ্রব্যমূল্যের ক্রমাগত বৃদ্ধিতে কমছে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ও প্রকৃত আয়। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দীর্ঘদিন ধরে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারা এ মূল্যস্ফীতির জন্য দায়ী করা হয়েছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধসহ বহিঃস্থ বা দেশের বাইরের উপাদানগুলোকে। যদিও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক মূল্যায়ন প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, দেশে মূল্যস্ফীতি জেঁকে বসেছে মূলত অভ্যন্তরীণ উপাদানগুলোর কারণেই।

সর্বশেষ জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে দেশের মূল্যস্ফীতির গতিবিধি নিয়ে গতকালই ‘ইনফ্লেশন ডায়নামিকস ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক নিয়মিত ত্রৈমাসিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে উঠে আসা তথ্য অনুযায়ী, এ তিন মাসে হেডলাইন মূল্যস্ফীতির অর্ধেকের বেশি বা ৫১ শতাংশ এসেছে খাদ্যপণ্য থেকে। এর মধ্যে বড় অবদান রেখেছে খাদ্যশস্য ও সবজির মূল্যবৃদ্ধি। এর আগে এপ্রিল-জুন প্রান্তিকে খাদ্যপণ্যে মূল্যস্ফীতির বড় প্রভাবক ছিল আমিষ পণ্য, মসলা ও রান্নায় ব্যবহৃত প্রয়োজনীয় পণ্য। পাশাপাশি চাল, গম ও সবজির দামে ঊর্ধ্বমুখিতারও ব্যাপক প্রভাব দেখা গেছে। এসব পণ্যের দাম ক্রমাগত বাড়তে থাকায় জুলাইয়ে বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে দাঁড়ায় গত এক যুগে সর্বোচ্চে। বিশেষ করে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার উঠে দাঁড়ায় ১৩ বছরে শীর্ষে।

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে না আসার পেছনে নীতিনির্ধারকদের কার্যকর পদক্ষেপ নিতে না পারাকে দায়ী করছেন বিশ্লেষকরা। তারা মনে করছেন, বিগত সরকার বাজার নিয়ন্ত্রণে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেনি। আর বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাজারে অভিযানের ওপরেই নির্ভর করছে বেশি। শুধু এর ওপর নির্ভর করে থাকলে তা কার্যকর হবে না।

জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিক শেষে দেশে খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের মূল্যস্ফীতির হার ৯ দশমিক ১৫ থেকে বেড়ে ৯ দশমিক ৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এপ্রিল-জুন প্রান্তিকে মূল্যস্ফীতির প্রধান কারণ হিসেবে দেখা হয়েছে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধিকে। তবে গত প্রান্তিকের মূল্যস্ফীতিতে এর প্রভাব কিছুটা কমেছে। হেডলাইন মূল্যস্ফীতিতে বাড়িভাড়ার পাশাপাশি স্বাস্থ্য ও ব্যক্তিগত সেবা খাতে ব্যয় বাড়ার মতো বিষয়গুলোর অবদানও গত প্রান্তিকে বেড়েছে। হেডলাইন মূল্যস্ফীতিতে গত প্রান্তিকে সেবা খাতের ২৫ শতাংশ ও পচনশীল পণ্যের ২৩ শতাংশ অবদান ছিল। যেখানে গত জুনে এ দুই খাতের অবদান ছিল যথাক্রমে ১২ ও ১৮ শতাংশ। অন্যদিকে গত জুনে অপচনশীল পণ্যের অবদান ৭০ শতাংশ থাকলেও গত সেপ্টেম্বরে তা ৫২ শতাংশে নেমে এসেছে।

বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বৈশ্বিক বাজারে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি, স্থানীয় মুদ্রার অবমূল্যায়নের মতো বহিঃস্থ ইস্যুগুলোকে মূল্যস্ফীতির জন্য বারবার দায়ী করা হয়েছে। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর মূল্যস্ফীতিতে আমদানিনির্ভর পণ্যের অবদান কমে গত সেপ্টেম্বর শেষে ২৬ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। যেখানে গত জুন শেষে মূল্যস্ফীতিতে এ ধরনের পণ্যের অবদান ছিল ৩৯ শতাংশ। একই সময়ে মূল্যস্ফীতিতে স্থানীয় পণ্যের অবদান গত জুনের ৬১ শতাংশ থেকে বেড়ে সেপ্টেম্বর শেষে ৭৪ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ডিস্টিংগুইশড ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘দেশে বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় হার কিছুটা স্থিতিশীল হয়ে এসেছে, যার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে মূল্যস্ফীতিতে আমদানি করা পণ্যের অবদানের ক্ষেত্রে। ফলে আগের তুলনায় মূল্যস্ফীতিতে আমদানি পণ্যের প্রভাব কিছুটা স্তিমিত হয়ে এসেছে। অন্যদিকে আমাদের অভ্যন্তরীণ পণ্যের মূল্যস্ফীতি বাড়ার ক্ষেত্রে নানা কারণ রয়েছে। এর মধ্যে সাম্প্রতিক বন্যা, বাজার ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা, সরবরাহ ও চাহিদার মধ্যে পার্থক্যের মতো বিষয় রয়েছে। সরকারের মজুদ দিয়ে পণ্য বিক্রি করে বাজারের মূল্যকে প্রভাবিত করার সক্ষমতা কম। টিসিবির ফ্যামিলি কার্ডের মাধ্যমে প্রকৃত সুবিধাভোগীদের কাছে পুরোপুরিভাবে পণ্য পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছে না। এটি করা গেলে বাজারে পণ্যের চাহিদা কমে আসত, যা দাম কমানোর ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে সক্ষম হতো। উচ্চ মূল্যস্ফীতির হার সাধারণভাবে গড়ে কিছুটা কমলেও মূল্যস্তর কিন্তু ওপরেই আছে। ফলে স্থির আয়ের মানুষের জীবনমানের ওপর মূল্যস্ফীতির প্রভাব অব্যাহত আছে। মূল্যস্ফীতি যে হারে বেড়েছে, সে হারে মজুরি বাড়েনি। এর ফলেও বাড়তি দামের কারণে মানুষকে দুর্ভোগে পড়তে হচ্ছে।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে আগের তিন মাসের তুলনায় প্রায় সব নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে। পুরো সময়জুড়েই কাঁচামরিচের দাম ছিল ঊর্ধ্বমুখী। এ সময় চাল ও পেঁয়াজের দাম কমার আগে প্রথমে বেড়েছিল। ডিমের দামের মার্জিন স্থিতিশীল হওয়ার আগে কিছুটা কমেছে। সোনালি মুরগির দাম স্থিতিশীল হওয়ার আগে জুন থেকে ক্রমাগত বেড়েছে। আবার এ সময়ে বাজারে সয়াবিন তেল, আলু ও মসুর ডালেও ক্রয় ও বিক্রয়মূল্যের মধ্যে স্থিতিশীল পার্থক্য দেখা গেছে।

২০২২ সালের এপ্রিল থেকে বাংলাদেশে মজুরি প্রবৃদ্ধির তুলনায় মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি ছিল তুলনামূলক বেশি। এতে ক্রয়ক্ষমতা কমেছে সাধারণ মানুষের। উল্লেখযোগ্য মাত্রায় অবনমন হয়েছে প্রকৃত আয়ে। তবে গত সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে ঢাকা ও রংপুর অঞ্চলে আয় কিছুটা বেড়েছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘২০২১-২২ সালের দিকে জ্বালানি তেলের দাম ও ডলারের বিনিময় হার বৃদ্ধির মতো বিষয়গুলো মূল্যস্ফীতি বাড়াতে ভূমিকা রাখলেও এর পরের সময়গুলোয় কিন্তু আমাদের নিজেদের নীতিগত ভুলের কারণেই মূল্যস্ফীতি কমানো সম্ভব হয়নি। কারণ জ্বালানি ও ডলারের দাম বাড়ার বিষয়টি সব দেশের জন্যই প্রযোজ্য। অন্যান্য দেশ কমাতে পারলেও আমরা কেন মূল্যস্ফীতি কমাতে পারিনি? তবে দেরিতে হলেও বাংলাদেশ ব্যাংক যে বাহ্যিক কারণের চেয়ে অভ্যন্তরীণ কারণে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে এ বিষয়টির স্বীকৃতি দিয়েছে, সেটি শুভ বুদ্ধির পরিচায়ক। অতীতে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি নেয়া হলেও সেটি সেভাবে বাস্তবায়ন করা হয়নি, বরং সরকার উল্টো পথে হেঁটেছে। সে সময় টাকা ছাপিয়ে সরকার ও কিছু ব্যাংককে তারল্য সহায়তা দেয়া হয়েছে। ডলারের বিনিময় হারের কারণে পণ্য আমদানি ব্যয় বেড়েছে। শুধু বৈশ্বিক কারণে নয়, আমাদের সম্প্রসারণমূলক মুদ্রানীতিও ডলারের বিনিময় হার বাড়ার ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে।’

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য বর্তমানে সরকার বাজেটের আকার কমানোর পাশাপাশি সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি বাস্তবায়নের পথে হাঁটলেও বাজার ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে আগের কৌশলই প্রয়োগ করছে বলে মনে করছেন ড. জাহিদ হোসেন। তিনি বলেন, ‘বাজারে যে অব্যবস্থাপনা চলছে সেটি দূর করার জন্য এখনো কার্যকর ব্যবস্থার ঘাটতি রয়েছে। বাজারে খেলোয়াড়ের পরিবর্তন হলেও খেলার কোনো পরিবর্তন হয়নি। পুরনো চাঁদাবাজদের জায়গায় নতুনরা এসে চাঁদাবাজি করছে। আগের মতোই পুলিশ ও ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তরের মাধ্যমে বাজার নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে। অথচ চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে সেভাবে ব্যবস্থা নেয়া যায়নি। মার্কেট পুলিশিং দিয়ে বিশ্বের কোথাও বাজার স্থিতিশীল করা যায় না, বরং এতে আরো অস্থিরতা বাড়ে। বাজারে নজরদারির ক্ষেত্রে কত দামে পণ্য বিক্রি হচ্ছে, কী পরিমাণ পণ্য বিক্রি হচ্ছে, সেগুলোর মজুদ কেমন আছে, বাজারে নতুন বিক্রেতার অন্তর্ভুক্তির পথ কতটা মসৃণ; সেটি গুরুত্বপূর্ণ। এক্ষেত্রে বাজারে প্রতিযোগিতা বাড়ানোর মাধ্যমে সিন্ডিকেটের প্রভাব খর্ব করতে হবে।’

২০২২-২৩ অর্থবছরের পুরো সময়ে ৯ শতাংশের ওপরে ছিল বাংলাদেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতি। গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি আরো বেড়ে ৯ দশমিক ৭৩ শতাংশে দাঁড়ায়। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসেও এ ঊর্ধ্বমুখিতা বজায় থাকতে দেখা গেছে। সর্বশেষ গত সেপ্টেম্বর শেষে দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৯২ শতাংশে। এর মধ্যে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১০ দশমিক ৪০ ও খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৫০ শতাংশ। সব মিলিয়ে টানা দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে। সেপ্টেম্বরে আগস্টের তুলনায় পরিসংখ্যানগতভাবে মূল্যস্ফীতি কিছুটা কম দেখালেও বাজারে নিত্যপণ্যের দামে এর তেমন কোনো প্রভাব নেই। বরং চলতি মাসে ডিম, মুরগি ও সবজির দামে আরেক দফা ঊর্ধ্বমুখিতা দেখা গেছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *