কয়েক দফায় ঋণের সুদহার বাড়ানোয় ব্যবসাবাণিজ্যে বিপর্যয় নেমে এসেছে। খরচ বৃদ্ধি পাওয়ায় থমকে গেছে বিনিয়োগ। ব্যবসায়ীরা বলছেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বিশ্বব্যাপী ভোক্তা ঋণের সুদহার বাড়ানো হলেও বাংলাদেশে বাড়ানো হয় শিল্পঋণের। ফলে ব্যাংকের ওপর নির্ভরশীল ব্যক্তিরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর দেশের বিভিন্ন স্থানে শিল্পকারখানায় হামলা, ভাঙচুর করা হয়েছে। এতে উৎপাদন বন্ধ রয়েছে অনেক কারখানার।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, চলতি বছর আগস্টের পর নীতিসুদহার বেড়েছে তিনবার, বর্তমানে নীতি সুদহার ১০ শতাংশ। এর ফলে ঋণের সুদহার ১৫ শতাংশ ছাড়িয়েছে। আগামীতে আরও বাড়বে।দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে ভোগ্যপণ্যের চাহিদা কমে উৎপাদনকারীদের বিক্রিতে ধস নেমে ঋণ পরিশোধে চাপ তৈরি হয়েছে। সুদহার বেড়ে যাওয়ায় এর সরাসরি আঘাত পড়ছে কর্মসংস্থানে। উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ার কারণে ‘সংকট’ বাড়ছে। এর ধাক্কা লাগছে কর্মহীন হয়ে পড়া বা উচ্চমূল্যের বাজারে খাপ খাওয়াতে না পারা কম বা সীমিত আয়ের মানুষের ওপর। অথচ মূল্যস্ফীতি কমানোর যে লক্ষ্য নিয়ে রেপো হার বাড়ানো হচ্ছে, সেই মূল্যস্ফীতি এখনো রয়ে গেছে ১০ দশমিক ৮৭ শতাংশে। এ ছাড়া সংকুচিত হয়েছে কিস্তি পরিশোধের সময়সীমা। আগে একজন গ্রাহক ছয়টি কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থ হলে খেলাপি হতো। গত সেপ্টেম্বর থেকে তিনটি কিস্তি পরিশোধ না করলে খেলাপি করার বিধি কার্যকর হয়েছে। এতে আবার আগামী বছরের মার্চ থেকে একটি কিস্তি পরিশোধ করতে ব্যর্থ হলেই খেলাপি হবে। এমন পরিস্থিতিতে টিকে থাকার লড়াই করছেন ব্যবসায়ীরা।
এ বিষয়ে দেশের ব্যবসায়ী শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এক সময়ের ঋণের ৯ শতাংশ সুদ এখন ১৫ শতাংশ ছাড়িয়েছে। দাম বাড়ার পরও চাহিদামতো জ্বালানি মিলছে না। মূলধনি যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানি কমেছে। কিছুদিন আগে শিল্পকারখানায় হামলা হয়েছে, উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। অনেক মালিক ঠিকমতো বেতন ও ঋণের কিস্তি দিতে পারছেন না। তিনি আরও বলেন, আগামী মার্চ থেকে একটা কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থ হলেই ঋণখেলাপি হবেন ব্যবসায়ীরা। শুধু তাই নয়, কোনো শিল্পগ্রুপের একটা প্রতিষ্ঠান খেলাপি হলে ওই গ্রুপের সব প্রতিষ্ঠানের ব্যাংকিং বন্ধ করে দেওয়া হয়। ফলে কাঁচামাল আমদানি করতে পারে না। ঋণখেলাপি করার এসব বিধি ধীরে ধীরে বাস্তবায়ন করতে হবে। পরিস্থিতি যখন উন্নত হবে তখন পর্যায়ক্রমে ঋণখেলাপি করার সময় কমিয়ে আনা যেতে পারে। কারা ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি, তাদের তালিকা প্রকাশ করার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, ৯৫ শতাংশ ব্যবসায়ী ব্যাংকের টাকা ফেরত দেন। ফেরত না দিলে ব্যাংকগুলো এত বড় হয়েছে কীভাবে?
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে পণ্য আমদানির এলসি (ঋণপত্র) খোলা ও নিষ্পত্তি উভয়ই কমেছে প্রায় ১৩ শতাংশ। গত জুলাই ও আগস্টে ১০ দশমিক শূন্য ৩ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানির এলসি খোলা হয়েছে, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ১ দশমিক ৪৮ বিলিয়ন ডলার বা ১২ দশমিক ৮৫ শতাংশ কম। ওই বছরের জুলাই-আগস্টে এলসি খোলা হয়েছিল ১১ দশমিক ৫১ বিলিয়ন ডলারের। গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুনে বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৯ দশমিক ৮৪ শতাংশ; আগের অর্থবছরের এই সময়ে যা ছিল ১০ দশমিক ৫৮ শতাংশ। ২০২৩-২৪ অর্থবছর শেষে জুনে বেসরকারি খাতে ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ১৬ লাখ ৪১ হাজার ২২৯ কোটি টাকা। আগের অর্থবছরের শেষে এর পরিমাণ ছিল ১৪ লাখ ৯৪ হাজার ২৫৬ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালের জুলাইয়ে ব্যাংক ঋণের গড় সুদহার ছিল ৭ দশমিক ৭৯ শতাংশ। চলতি বছরের জুলাইয়ে তা বেড়ে হয়েছে ১১ দশমিক ৫৭ শতাংশ। এদিকে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের দায়িত্ব নেন অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর, যিনি আগে থেকেই সুদহার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি কমানোর কথা বলে আসছিলেন। দায়িত্ব নেওয়ার পর সে পথেই হেঁটেছেন তিনি। প্রথমে ২৫ আগস্ট ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে নীতি সুদহার করেন ৯ শতাংশ। পরের মাসে এটি আবার ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ৯ দশমিক ৫০ শতাংশ করেন। সর্বশেষ ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে নীতিসুদহার ১০ শতাংশ করা হয়েছে। এতে ঋণের সুদহার ১৫ শতাংশ ছাড়িয়েছে। ঢাকা মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সাবেক সভাপতি সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেন, ‘এমন দেশ নেই যেখানে ব্যবসায়ীরা দুই অঙ্কের ব্যাংক সুদহারে মুনাফা করতে পারেন।’
নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আগামী মার্চ থেকে একটা কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থ হলে ঋণখেলাপি হবেন ব্যবসায়ীরা। এতে ঋণ খেলাপির পরিমাণ অনেক বেড়ে যাবে। বিশ্বব্যাংক বলছে, বাংলাদেশসহ সাতটি দেশ অর্থনৈতিকভাবে দেউলিয়া হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে ঋণখেলাপি করার সময় কমিয়ে তিন মাস করা হলো। আমার মনে হয়, এখন যে সংকট চলছে এই সময়ে একটু শিথিল করতে হবে। আমরা অনুরোধ করব কম করে হলেও এক বছরের জন্য ওই সার্কুলারটা রহিত করা হোক। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক হুসনে আরা শিখা বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরের নির্দেশনা একদম স্পষ্ট। যতক্ষণ মূল্যস্ফীতি সিংগেল ডিজিটে না নামবে ততক্ষণ নীতি সুদহার বাড়তে থাকবে।