ক্রান্তিকালে বাংলাদেশকে নতুনভাবে পরিচয় করিয়ে দেয় প্লামি ফ্যাশনস

নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার কাশিপুর ইউনিয়নের উত্তর নরসিংহপুরে সাত একর বা ২২ বিঘা জমির ওপর প্লামি ফ্যাশনস লিমিটেডের কারখানা। এর মোট এলাকার ৬০ শতাংশ জায়গা খোলা, সেখানে কোনো অবকাঠামো গড়ে তোলা হয়নি। লাগানো হয়েছে দেশীয় প্রজাতির বিভিন্ন গাছ। কারখানার ভেতরেই আছে লেক। দোতলা মূল কারখানা ভবনটি ইস্পাতের (প্রি-ফ্যাব্রিকেটেড বিল্ডিং) তৈরি। তিন পাশেই আছে লম্বা বারান্দা। ওঠানামার জন্য পাঁচটি সিঁড়ি থাকলেও বের হওয়ার দরজার সংখ্যা ৯।

জ্বালানির কম ব্যবহার ও পরিবেশগত মান রক্ষার দিক দিয়ে প্লামি পেয়েছে বিশ্বের সেরা পোশাক কারখানার স্বীকৃতি। ২০১৪ সালে চালু হওয়ার কয়েক মাস পরই বিশ্বের প্রথম পরিবেশবান্ধব নিট পোশাক কারখানা হিসেবে এ স্বীকৃতি দেয় আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ইউএস গ্রিন বিল্ডিং কাউন্সিল (ইউএসজিবিসি)। প্লামি ফ্যাশনস প্রতিষ্ঠার পেছনের গল্প ও বর্তমান কার্যক্রম নিয়ে সম্প্রতি কথা বলেছেন প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফজলুল হক—

প্লামি ফ্যাশনস চালু করা হয় ২০১৪ সালে। এর পেছনের গল্পটা অনেক ইন্টারেস্টিং। ২০১৩ সালে রানা প্লাজার ধস ও তার আগের বছর তাজরীন ফ্যাশনসের যে ঘটনা (অগ্নিকাণ্ডে নিহত হন ১১৭ পোশাককর্মী) তা বিশ্বদরবারে বাংলাদেশের সুনাম নষ্ট করে। পৃথিবীর অনেক স্টোরেই বাংলাদেশকে বয়কটের একটা ডাক আসে। তখন আমরা চিন্তা করলাম এমন কী করা যায়, যার মাধ্যমে বিশ্বদরবারে বাংলাদেশকে নতুনভাবে পরিচয় করিয়ে দেয়া যাবে। দেখানো যায় যে বাংলাদেশও পারে। রানা প্লাজার দুর্ঘটনা নিয়ে সৃষ্ট নেতিবাচক পরিচিতি আমাদের অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে। তখন আমরা অনেক খোঁজখবর নিলাম। জানলাম যে পৃথিবীর অনেক দেশে গ্রিন ফ্যাক্টরি নামে পরিবেশবান্ধব কিছু কারখানা তৈরি করা হয়। এগুলোর আবার অনেক গ্রেডিং আছে। সেখান থেকে উদ্বুদ্ধ হয়ে চিন্তা করলাম আমরা বিশ্বের এক নম্বর গ্রিন ফ্যাক্টরি নির্মাণ করব। পৃথিবীর সেরা ফ্যাক্টরি করার একটা লক্ষ্য নিয়ে মাঠে নেমে পড়ি। ২০১৫ সালে প্লামি পৃথিবীর সর্বোচ্চ নম্বরধারী গ্রিন ফ্যাক্টরি ছিল, আমাদের স্কোর ছিল ৯২। বর্তমানে হয়তো আরো অনেকে আমাদের অতিক্রম করতে পেরেছে। তবে সে সময় আমরাই ছিলাম প্রথম। পরবর্তী সময়ে দুই-তিন বছর আমরাই হাইয়েস্ট নম্বরধারী ছিলাম।

ইউএসজিবিসির গ্রিন সার্টিফিকেশনের তিনটা মূল স্তম্ভ আছে। প্রথম স্তম্ভ হলো কারখানাকে আমরা কতটা বিদ্যুৎসাশ্রয়ী করছি। বিদ্যুৎসাশ্রয়ী করার ক্ষেত্রে একটি কারখানায় মোট যে পরিমাণ বিদ্যুৎ লাগে তার ১৩ শতাংশ নবায়নযোগ্য উৎস থেকে আসতে হবে। বাংলাদেশে নবায়ণযোগ্য জ্বালানি বলতে সোলার প্যানেলই বোঝায়। আমাদের এখানে সোলার প্যানেলও আছে। আমরা যখন এটি স্থাপন করি তা বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সোলার প্যানেল ছিল। আরেকটি স্তম্ভ হচ্ছে পানি সাশ্রয় করা। আমরা রেইন ওয়াটার হার্ভেস্ট করি, যেটা ছাদ থেকে পাইপের মাধ্যমে আন্ডারগ্রাউন্ডে নিয়ে যাওয়া হয়। সেটা আমরা টয়লেটের ফ্লাশে ব্যবহার করি, যাতে তা পরিশোধন করা না লাগে। আমরা পানিও সাশ্রয় করি। যেসব নল ব্যবহার করি সেগুলোয় এক মিনিটে দেড় লিটারের বেশি পানি বের হয় না। সাধারণত বাসাবাড়িতে যেসব নল ব্যবহার করা হয় সেগুলোয় এক মিনিটে পানি বের হয় আট লিটার। এতে অপচয় হয়। সর্বশেষ স্তম্ভ হলো কত কম কার্বন নিঃসরণ করতে পারছি। অন্যান্য কারখানার তুলনায় আমরা ৪০ শতাংশ কম বিদ্যুৎ ব্যবহার করি, ৪২ শতাংশ কম পানি ব্যবহার করি, ৩৫ শতাংশ কম কার্বন নিঃসরণ করি।

বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের ক্ষেত্রে আমরা আরেকটি যে কাজ করি সেটা হলো আমাদের গ্রাউন্ড ফ্লোরে অনেক কম লাইট ব্যবহার করা হয়। সূর্যের আলোকেই বেশি প্রাধান্য দেয়া হয়। কারখানায় স্কাই লাইট লাগানো আছে, সেটার কাজ হলো সূর্যের আলোকে ভেতরে নিয়ে আসবে, কিন্তু কোনো তাপ ভেতরে আসবে না। সূর্যের আলোর সঙ্গে যদি তাপটা চলে আসে তাহলে এখানে কেউ কাজ করতে পারবে না। এছাড়া আমাদের ছাদে বিশেষ এক ধরনের স্টিল ব্যবহার করা হয়, যেটা বাইরের তাপকে রিফিউজ করে দেয়। প্লামির ফ্যাক্টরির ভেতরে আবহাওয়া খুব ভালো। ঢাকার বায়ুর যে মান সে অনুযায়ী দেড় গুণ বেশি ভালো। এ রকম আরো অনেক কিছু মেইনটেইন করি। প্রায় ১০ বছর ধরে আমরা এ কারখানাকে অনেক যত্নের সঙ্গেই নিয়ন্ত্রণ করছি।

বাংলাদেশের কারখানা বলতে আমরা বুঝি নয় বা ১০ তলা একটা বিল্ডিং। আমাদের কারখানাটি এমন না। প্লামির ছয়টি বিল্ডিং আছে কিন্তু দোতলার ওপরে কোনো স্থাপনা নেই। আমাদের প্রতিটি অ্যাক্টিভিটিজের জন্য আলাদা আলাদা বিল্ডিং রয়েছে। প্রডাকশন, ডায়িং, স্টোরেজ, অ্যাডমিন, নন-প্রডাকশন অ্যাক্টিভিটি সবকিছু আলাদা আলাদা বিল্ডিংয়ে হয়। এছাড়া নামাজের জায়গা আছে, ট্রেনিং সেন্টার আছে, খাবারের আলাদা জায়গা আছে, মেডিকেল সেন্টার আছে এবং চাইল্ড কেয়ার আছে। দুইতলা বিল্ডিং হওয়ায় আমাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থাও কঠোর। ফায়ার এক্সিটেরও সুব্যবস্থা রয়েছে। কখনো আগুন লাগলে আমাদের কারখানা খালি করতে লাগে ৩০ সেকেন্ড। মূল ফ্যাক্টরি বিল্ডিংয়ে আমাদের নয়টি এক্সিট আছে। পরিবেশের দিকেই আমরা সর্বোচ্চ নজর দিচ্ছি।

গ্রিন ফ্যাক্টরির যে কনসেপ্ট নিয়ে কাজ করছিলাম, তখন সেটা বাংলাদেশে নতুন ছিল। তাই দেশে তখন টেকনিক্যাল এক্সপার্ট পাইনি, সেটা শ্রীলংকা থেকে হায়ার করতে হয়। আমাদের প্রতিপদে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হয়েছে। সরকারের কোনো পলিসিতে গ্রিন ফ্যাক্টরির কথা ছিল না। তাই গ্রিন ফান্ডিংটাও আমাদের জন্য একটা চ্যালেঞ্জ ছিল। সে সময় এটা ছিল না।

একটি স্ট্যান্ডার্ড ফ্যাক্টরির তুলনায় আমাদের ২০-৩০ শতাংশ বেশি লেগেছে এ কারখানা তৈরি করতে গিয়ে। তবে প্লামি ফ্যাশনস পুরোপুরি নিজস্ব অর্থায়নে তৈরি হয়নি। ব্যাংক লোনও ছিল। বাংলাদেশ ব্যাংক ও অন্যান্য কমার্শিয়াল ব্যাংক থেকে সে সময় আমরা সহযোগিতা পেয়েছি।

প্লামি ফ্যাশনসে প্রায় দুই হাজার শ্রমিক কাজ করেন। কর্মক্ষেত্রে তারা যাতে কমফোর্ট ফিল করেন সে ধরনের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। ফ্যাক্টরির ভেতরের টেম্পারেচার কখনই ২৮ ডিগ্রির ওপরে উঠে না। আমাদের মূল যে কারখানা সেটার চারদিকে বারান্দা দেয়া আছে। যারা দূর থেকে আসেন, আমরা তাদের উৎসাহিত করি সাইকেলে যাতায়াত করার জন্য। তাহলে ডিজেল খরচ কমবে। যারা সাইকেল চালিয়ে আসেন তাদের জন্য টপ কোয়ালিটির শাওয়ার ফ্যাসিলিটি রয়েছে। কাজের পাশাপাশি শ্রমিকদের মেন্টাল রিফ্রেশমেন্টের ওপরও গুরুত্ব দেয়া হয়।

আমরা পুরোপুরি সার্কুলার-নিট টাইপের পণ্য প্রস্তুত করি। আমাদের মাসে উৎপাদনক্ষমতা ১০ লাখ পিসের মতো। আসলে প্রডাক্টের ওপর উৎপাদনক্ষমতা নির্ভর করে। আমাদের পণ্য রফতানি হচ্ছে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, ফ্রান্স, ব্রাজিলসহ আরো বেশকিছু দেশে। আমাদের মূল লক্ষ্য দেশের মানুষের কর্মসংস্থান বাড়ানো। তাই কর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রে আমরা দেশের লোকজনকে অগ্রাধিকার দিই। সেই সঙ্গে আমরা চাই, পোশাক খাতে এ ধরনের আরো কারখানা হোক, যাতে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *