ছোট প্রতিষ্ঠান বড় দায়িত্বে টিসিবি

সারা দেশে নিম্ন আয়ের মানুষের কাছে স্বল্পমূল্যে পণ্য বিক্রির উদ্দেশ্য থেকে স্বাধীনতার পর গড়ে তোলা হয়েছিল ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)। সময়ের পরিক্রমায় সংস্থাটির বিপণন কার্যক্রমের উপকারভোগীর সংখ্যা বেড়েছে। বর্তমানে শুধু ফ্যামিলি কার্ডের মাধ্যমেই সরাসরি উপকারভোগী হিসেবে সংস্থাটির তালিকাভুক্ত রয়েছে এক কোটি পরিবার। তবে মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতি বিবেচনায় বর্তমানে কার্ডধারীদের বাইরেও পণ্য বিক্রি করছে টিসিবি। বিপণন কেন্দ্রগুলোর সামনে এখন লাইনে দাঁড়াচ্ছে অনেক মধ্যবিত্ত পরিবারের সদস্যরাও। কার্যক্রমের পরিধি ক্রমেই বাড়লেও সংস্থাটির সক্ষমতা সেভাবে বাড়েনি। গুদাম ও লোকবলের অভাবে ব্যাপক বিঘ্নিত হচ্ছে টিসিবির সেবা কার্যক্রম।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, টিসিবি এখনো বৃহদায়তনে পণ্যের ভোক্তামূল্যে প্রভাব ফেলার মতো প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা গড়ে তুলতে পারেনি। এক কোটি নিয়মিত গ্রাহকের বাইরে নতুন প্রেক্ষাপটে কার্ড ছাড়াও সেবা দিতে হচ্ছে সংস্থাটিকে। কিন্তু এত বড় কর্মযজ্ঞ পরিচালনায় টিসিবির বাজেটও অপ্রতুল। আবার গুদামজাতের সক্ষমতাও নেই বললেই চলে। যেভাবে গ্রাহক সংখ্যা বাড়ছে তাতে করে এ প্রতিষ্ঠানের পক্ষে এত বড় কার্যক্রম পরিচালনা প্রায় অসম্ভব। সাধারণ মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণে আর কোনো প্রতিষ্ঠানও নেই। অথচ বিদ্যমান মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এবং বাজারে হস্তক্ষেপের মাধ্যমে স্বল্প আয়ের মানুষকে সুরক্ষা দেয়ার ক্ষেত্রে সরকারের বড় হাতিয়ার হয়ে ওঠার সুযোগ ছিল টিসিবির।

সংস্থাটির কার্যক্রম পরিচালনায় প্রধান কার্যালয়ের বাইরে সারা দেশে আঞ্চলিক কার্যালয় স্থাপন করা হয়েছে ১৪টি। এসব কার্যালয়ের অধীনে স্থায়ী কর্মীর অনুমোদিত পদ সংখ্যা ২৭৫। কার্যক্রমের আওতা ও পরিধি বিবেচনায় এ অনুমোদিত পদ সংখ্যা অপর্যাপ্ত বলে মনে করছেন টিসিবি কর্মী ও সংশ্লিষ্টরা। যদিও এর অর্ধেকের কাছাকাছি সংখ্যক পদ এখনো ফাঁকা রয়ে গেছে। সংস্থাটির তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে টিসিবিতে স্থায়ী কর্মীর সংখ্যা ১৪৬। তাদের ও সারা দেশের ৮ হাজার ২৫০ ডিলারের মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে সংস্থাটির কার্যক্রম। এছাড়া পণ্য সংরক্ষণের জন্যও পর্যাপ্ত গুদাম নেই টিসিবির। বর্তমানে সংস্থাটির নিজস্ব গুদাম রয়েছে চারটি। এর বাইরে ১১টি গুদাম ভাড়া করে কার্যক্রম চালাতে হচ্ছে সংস্থাটিকে।

ভোক্তা ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পর্যাপ্ত সক্ষমতার অভাব ও কাঠামোগত দুর্বলতার কারণে প্রয়োজনীয় প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা তৈরি হয়নি সংস্থাটির। বর্তমানে দেশে সার্বিক ও খাদ্য মূল্যস্ফীতি লাগামহীন হয়ে উঠলেও স্বল্পমূল্যে বিপণন কার্যক্রম পরিচালনার মাধ্যমে বাজারে শৃঙ্খলা ফেরানোয় কাঙ্ক্ষিত ভূমিকা রাখতে পারেনি টিসিবি। উল্টো লোকবল ও গুদাম সংকটের কারণে বিপণন পণ্যের বৈচিত্র্য বাড়াতে পারছে না সংস্থাটি। বর্তমানে টিসিবি চারটি পণ্য স্বল্পমূল্যে বিক্রি করছে। এগুলো হলো ভোজ্যতেল, মসুর ডাল, চাল ও আলু।

দেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতি এখন ১২ দশমিক ৬৬ শতাংশ। টিসিবির পণ্যের ধরন, পরিমাণ ও বিপণনের আওতা বাড়ানো গেলে তা বিদ্যমান মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বড় ধরনের ভূমিকা রাখতে পারত বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের ভাষ্যমতে, দ্রব্যমূল্যের দাম বাড়তে থাকায় এ মুহূর্তে টিসিবির সক্ষমতা ও কার্যক্রম বাড়ানো জরুরি হয়ে পড়েছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে সারা দেশের স্বল্প আয়ের জনগোষ্ঠীকে সুরক্ষা দিতে সংস্থাটির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার সুযোগ আছে।

অর্থনীতিবিদ এবং বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি ব্যবসা ও বিপণন বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমরা দেখছি সরকার বিভিন্ন খাদ্যপণ্যে শুল্ক প্রত্যাহার করলেও দাম নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না। এর ফলে নতুন করে দরিদ্র মানুষের হার বাড়ছে। অনেক মধ্যবিত্তও হিমশিম খাচ্ছে সংসার চালাতে। ফলে সরকারের সামাজিক সুরক্ষা খাতের কার্যক্রম আরো বাড়ানো দরকার। একই সঙ্গে টিসিবি যে স্বল্পমূল্যে পণ্য বিক্রি করে সেটিরও কার্যক্রমের পরিধি ও আওতা বাড়ানো দরকার, যাতে সারা দেশেই দরিদ্র বা নিম্ন আয়ের মানুষ একটা সুরক্ষা পায়। এজন্য সংস্থাটির সক্ষমতা বাড়ানো এখন জরুরি হয়ে পড়েছে।’

দ্রব্যমূল্য ক্রমাগত বাড়তে থাকায় টিসিবির ট্রাকসেলে বা বিপণন কেন্দ্রে স্বল্পমূল্যে পণ্য কিনতে আসা মানুষের লাইন ক্রমেই দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। বর্তমানে ফ্যামিলি কার্ড ছাড়াও পণ্য বিক্রি শুরু হলেও তাতে ক্রেতাদের চাহিদা পূরণ হচ্ছে না। প্রতিদিন বিপণন কেন্দ্রগুলোর সামনে দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়েও পণ্য কিনতে না পেরে ফিরে যাচ্ছেন অনেকেই।

রাজধানীর মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটের সামনে টিসিবি ট্রাকসেল লাইনে গতকাল পণ্য কিনতে এসেছিলেন আসাদুজ্জামান খান সোহেল। চাকরি করছেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। চারজনের সংসারে তিনিই একমাত্র কর্মক্ষম ব্যক্তি। অতীতে কখনো টিসিবির লাইনে না দাঁড়ালেও বর্তমানে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ায় এসেছেন ট্রাকসেলের লাইনে। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘বেতন বাড়েনি। তবে বাসা ভাড়া বেড়েছে। ইউটিলিটি বিলসহ অন্যান্য খরচও বেড়েছে। বাচ্চার চিকিৎসা খরচ, নিজের অফিস যাতায়াতের খরচ, সব পণ্যের দামও বেড়েছে। ফলে এ বেতনে সবকিছু ম্যানেজ করা সম্ভব হচ্ছে না। তাই এখানে আসা কিছু কম মূল্যে পণ্য কেনার জন্য। আগেও এখানে অনেকক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে পণ্য না কিনে ফেরত যেতে হয়েছে। একেকটি ট্রাকে লোক থাকে তিন-চারজন। তাদের পক্ষে ক্রেতাদের এত বিশাল চাপ সামাল দেয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে।’

প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতায় পিছিয়ে থাকার পাশাপাশি সংস্থাটির বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগও কম নয়। ২০১৮-১৯ থেকে ২০২০-২১ সালের তথ্যের ভিত্তিতে করা বাংলাদেশ কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেলের (সিএজি) এক নিরীক্ষা প্রতিবেদনে (২০২২ সালের ৩৫ নম্বর কমপ্লায়েন্স অডিট রিপোর্ট) উঠে এসেছে, এ সময়ের মধ্যে সংস্থাটিতে ২৯৭ কোটি ৬ লাখ টাকার অনিয়ম ও দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়া গেছে।

আবার প্রক্রিয়া ও পদ্ধতিগত জটিলতার কারণে সংস্থাটির কেনাকাটায়ও প্রচুর সময় ও অর্থ ব্যয় হয়। পর্যাপ্ত নগদ তহবিল না থাকায় সংস্থাটিকে কেনাকাটা চালাতে হয় ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে। এ ঋণের সুদহার পরিশোধ করতে গিয়ে টিসিবির পণ্যের দামও কিছুটা বেড়ে যায়।

সংস্থাটিতে বাজেট বরাদ্দের বিষয়ে টিসিবির দায়িত্বপ্রাপ্ত তথ্য কর্মকর্তা এবং ঢাকা আঞ্চলিক কার্যালয়ের প্রধান মো. হুমায়ুন কবির বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমরা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েই পণ্য কিনে বিক্রি করি। সেখানে ভর্তুকির যে অর্থ, সেটি সরকার থেকে দেয়া হয়। ঋণের সুদের কারণে পণ্যের দাম কিছুটা বাড়তি রাখতে হয়।’

প্রসঙ্গত, স্বাধীনতার পর যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের জনসাধারণকে ভোগ্যপণ্য সরবরাহ নিশ্চিতের উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রপতির এক আদেশবলে ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয় টিসিবি। সংস্থাটি এখন নিত্যপ্রয়োজনীয় কয়েকটি পণ্য যেমন ভোজ্যতেল, চিনি, মসুর ডাল ও আলু সাশ্রয়ী মূল্যে বিক্রি করছে। এছাড়া রমজান উপলক্ষে ছোলা ও খেজুর আমদানি এবং তা দেশব্যাপী ডিলারদের দ্বারা সাশ্রয়ী মূল্যে নিম্ন আয়ের মানুষের কাছে বিক্রয় করে সংস্থাটি।

টিসিবির কার্যক্রমের বর্তমান পরিস্থিতি ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চাইলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব মোহাম্মদ সেলিম উদ্দিন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘যেহেতু বড় ধরনের কেনাকাটার দরকার হয়, তাই আমরা টিসিবির গুদাম সুবিধা ধারাবাহিকভাবে বাড়াচ্ছি। সংস্থাটির প্রধান ও জেলাভিত্তিক মিলিয়ে মোট ১৫টি কার্যালয়ে লোকবল আছে ১৪৬ জন, যা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। আমরা সংস্থাটির দায়িত্বশীলদের বলেছি লোকবল বাড়াতে। এছাড়া প্রত্যেক জেলায় যাতে স্টোরেজ ও লোকবল থাকে সেটা নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে। আমরা এটা নিয়ে কাজ করছি। টিসিবি স্থানীয় বাজার থেকে পণ্য কিনে সেটা বিক্রি করে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী টিসিবি এখন আন্তর্জাতিক বাজার থেকে ক্রয়ের জন্য উদ্যোগ ও ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। এ বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে যা যা সহায়তা লাগে সেটি নিশ্চিত করা হবে।

তিনি আরো বলেন, ‘সংস্থাটি নিয়ে সরকারের আরো কিছু পরিকল্পনা আছে। যেমন টিসিবির যে ডিলার বা বিপণন কেন্দ্র আছে; সেগুলোর সামনে পণ্যক্রয়ের দীর্ঘ লাইন দেখা যায়। এ চিত্র বদলাতে কার্ডের মাধ্যমে ভোক্তার সুবিধামতো সময়ে পণ্য ক্রয়ের সুযোগ সৃষ্টি করা হচ্ছে। নতুন দুটি কার্যক্রমের উদ্যোগের চিন্তা রয়েছে। এর অংশ হিসেবে ঢাকার পাশে ১০ লাখ শ্রমিকের মধ্যে টিসিবি কার্যক্রম পরিচালনার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। ভবিষ্যতে এর ব্যাপ্তি আরো বাড়বে। এরই মধ্যে কার্যক্রমটি উদ্বোধন হয়েছে। আর রয়েছে ট্রাকসেল কার্যক্রম। ভবিষ্যতে এ কর্মসূচিটি যেন জরুরি প্রয়োজনে যেকোনো জেলায় নিশ্চিত করা যায়, তার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *