টানেল ও মহাসড়কের টোলের বড় অংশ নিয়ে যায় ঠিকাদার

পদ্মা সেতু, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মহাসড়ক ও চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে নির্মিত বঙ্গবন্ধু টানেল—এই তিন অবকাঠামো নতুন; কিন্তু এগুলোর মেরামত, রক্ষণাবেক্ষণ ও টোল আদায়ে বিপুল ব্যয় ধরে ঠিকাদার নিয়োগ করা হয়েছে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে। আর ঠিকাদার কাজ পেয়েছে কোনো প্রতিযোগিতামূলক দরপত্র ছাড়া।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, দরপত্র ছাড়া নিজেদের পছন্দে ঠিকাদার নিয়োগে লাভবান হয়েছে কাজ পাওয়া প্রতিষ্ঠান। সুবিধা নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে তৎকালীন মন্ত্রী ও কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে। লোকসান হয়েছে দেশের মানুষের। তাঁদের এখন ঋণের বোঝা টানতে হচ্ছে, অন্যদিকে চলাচলে খরচ পড়ছে বেশি। অবকাঠামোগুলো থেকে যে আয় হচ্ছে, তার বড় অংশ নিয়ে যাচ্ছে ঠিকাদার।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মহাসড়কে (এক্সপ্রেসওয়ে) টোল আদায় ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য দক্ষিণ কোরিয়ার একটি কোম্পানিকে দরপত্র ছাড়া কাজ দিয়েছে আওয়ামী লীগ সরকার। টোল আদায়ের জন্য তারা বছরে পাবে প্রায় ৯৬ কোটি টাকা। অথচ বঙ্গবন্ধু যমুনা বহুমুখী সেতুতে বছরে মাত্র ১২ কোটি টাকায় টোল আদায় করছে চীনা কোম্পানি। প্রতিযোগিতামূলক দরপত্রে কাজ পেয়ে গত ১ সেপ্টেম্বর থেকে যমুনা সেতুতে তারা টোল আদায় শুরু করে।

সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তর এক্সপ্রেসওয়ের টোল আদায় ও সেটির রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ পাঁচ বছরে কোরীয় প্রতিষ্ঠানটিকে দেবে ৭১৭ কোটি টাকা। চালুর পর এক্সপ্রেসওয়েটি থেকে এখন পর্যন্ত যে টোল আদায় হয়েছে, তার ৮০ শতাংশই চলে গেছে ঠিকাদারের পেছনে।

সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান প্রথম আলোকে বলেন, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে যত কেনাকাটা ও ঠিকাদার নিয়োগের ঘটনা ঘটেছে, প্রায় সবই প্রশ্নবিদ্ধ। যোগসাজশের ব্যাপক অভিযোগ আছে। এসব চুক্তি পর্যালোচনা করা হবে।

পদ্মা সেতু, টানেল ও এক্সপ্রেসওয়ে—এই তিন অবকাঠামো সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের অধীন। অভিযোগ আছে, তৎকালীন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এবং সেতু বিভাগের তখনকার সচিব খোন্দকার আনোয়ারুল ইসলামের সঙ্গে ঠিকাদারদের সখ্য ছিল। দুজনের তৎপরতায় আওয়ামী লীগ সরকার দরপত্র ছাড়া সরাসরি ক্রয়পদ্ধতিতে ঠিকাদার নিয়োগ দেয়। খোন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম পরে মন্ত্রিপরিষদ সচিব হন।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ওবায়দুল কাদের আত্মগোপনে চলে যান। তাঁর বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি। তবে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব খোন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, পদ্মা সেতু ও টানেল জটিল স্থাপনা। ওই দুটিতে টোল আদায় ও রক্ষণাবেক্ষণে ঠিকাদার নিয়োগ হয়েছে জিটুজি ভিত্তিতে (সরকারের সঙ্গে সরকারের সমঝোতায়)। যে ঠিকাদার নির্মাণ বা তদারকিতে ছিল, তাদের রক্ষণাবেক্ষণ ও টোল আদায় করার দায়িত্ব দিলে ভালো হবে—এই বিবেচনা ছিল সরকারের।

নিজের সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, ঠিকাদার এসেছে সংশ্লিষ্ট দেশের সরকারের মাধ্যমে। এখানে তাঁর কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই।

পদ্মা সেতু

৩১ হাজার কোটি টাকার বেশি ব্যয়ে নির্মিত পদ্মা সেতুর টোল আদায় ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ২০২২ সালের এপ্রিলে কোরিয়া এক্সপ্রেসওয়ে করপোরেশন (কেইসি) ও চীনের চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানিকে (এমবিইসি) নিয়োগ দেয় সেতু বিভাগ। ব্যয় ধরা হয় ৬৯৩ কোটি টাকা, মেয়াদ পাঁচ বছর।

কেইসি পদ্মা সেতু নির্মাণ তদারকিতে পরামর্শকের দায়িত্ব পালন করেছিল। এমবিইসি মূল সেতু নির্মাণে ঠিকাদার ছিল। মূলত তদারক ও নির্মাণে যুক্ত থাকা অবস্থাতেই এই দুই প্রতিষ্ঠান সেতুটির টোল আদায় ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজ পেতে তৎপর হয়।

পদ্মা সেতু প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়েছে গত জুনে। ওই সময় পর্যন্ত মূল সেতু ও নদীশাসনের ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তা মেরামত করার দায়িত্ব ছিল মূল নির্মাতা এমবিইসির। কিন্তু প্রকল্প শেষ হওয়ার ২৬ মাস আগেই মূল সেতু ও নদীশাসনের কাজ, রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামতের জন্য নতুন ঠিকাদার নিয়োগ দেওয়া হয়। সংযোগ সড়ক, দুই পাড়ের ভবন ও অন্যান্য অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণে ব্যয় ধরা হয়েছে ৮৮ কোটি টাকা। সেতু বিভাগ সূত্র বলছে, নতুন এই সেতুর প্রথম পাঁচ বছর তেমন কোনো মেরামতের দরকার নেই। ভবন বা অন্যান্য স্থাপনারও টুকটাক বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম পরিবর্তন ছাড়া ব্যয় নেই। এর পরও ৮৮ কোটি টাকা রক্ষণাবেক্ষণে ব্যয় অস্বাভাবিক।

সেতু বিভাগের দায়িত্বশীল একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, একটি বড় সেতুর ‘সার্ভিস লাইফ’ (যত দিন বড় কোনো মেরামতকাজ দরকার হয় না) ২৫ বছর ধরা হয়। এরপর সরঞ্জাম প্রতিস্থাপন ও বড় মেরামত প্রয়োজন হয়। যমুনা সেতু নির্মাণের ২৬ বছর পর গত মে মাসে সেতুটির বড় মেরামত কাজে ১২৮ কোটি টাকায় ঠিকাদার নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

অন্তর্বর্তী সরকার গত মাসে যমুনা সেতুর টোল আদায়ে পাঁচ বছরের জন্য আলাদা ঠিকাদার নিয়োগ দিয়েছে ৬০ কোটি টাকায়। অর্থাৎ পুরোনো এই সেতুর টোল আদায় ও বড় মেরামতে পাঁচ বছরে ১৮৮ কোটি টাকা ব্যয় হচ্ছে। আর নতুন পদ্মা সেতুর টোল আদায় ও মেরামতে ঠিকাদার নিয়োগ দেওয়া হয়েছে প্রায় চার গুণ টাকায় (৬৯৩ কোটি)।

পদ্মা সেতুর দৈর্ঘ্য ছয় কিলোমিটারের কিছু বেশি। যমুনা সেতুর দৈর্ঘ্য ৪ দশমিক ৮ কিলোমিটার। যমুনার চেয়ে পদ্মা সেতুর টোল দ্বিগুণ। একটি বড় বাস পদ্মা সেতু পাড়ি দেয় দুই হাজার টাকা দিয়ে। যমুনায় তা এক হাজার টাকা। সেতু বিভাগ সূত্র জানায়, পদ্মা সেতুতে এখন মাসে টোল আদায় হয় গড়ে ৮০ কোটি টাকা। এর প্রায় ১৫ শতাংশের কাছাকাছি চলে যায় ঠিকাদারের পেছনে।

পদ্মা সেতুর টোল আদায়ে কোরিয়া এক্সপ্রেসওয়ের সঙ্গে চুক্তিতে একজন টোল আদায়কারীর বেতন ধরা আছে ৭৮ হাজার টাকার কিছু বেশি। বাস্তবে বেতন দেওয়া হয় ৪ ভাগের ১ ভাগ। এভাবে প্রতিটি পদে উচ্চ বেতন ধরে খরচ বাড়িয়ে দেখানোর অভিযোগ রয়েছে। কর্মীরা ২০২২ সালের আগস্টে সেতু বিভাগে এ বিষয়ে অভিযোগ করেন। সাত সদস্যের তদন্ত কমিটি অভিযোগের সত্যতাও পেয়েছিল; তবে সেতু বিভাগ কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।

এক্সপ্রেসওয়ে

ঢাকা থেকে ফরিদপুরের ভাঙা পর্যন্ত এক্সপ্রেসওয়ে চালু হয় ২০২১ সালে। তবে টোল আদায় শুরু হয় ২০২২ সালের ১ জুলাই থেকে। পদ্মা সেতুর মতো এক্সপ্রেসওয়েতে টোল আদায় ও রক্ষণাবেক্ষণের ঠিকাদার কোরীয় প্রতিষ্ঠান কেইসি। গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এক্সপ্রেসওয়েতে টোল আদায় হয়েছে ৩৮৮ কোটি টাকা। জুন পর্যন্ত ২০৬ কোটি টাকা বিল দেওয়া হয়েছে ঠিকাদারকে।

এক্সপ্রেসওয়েটি নির্মাণে শুরুতে ব্যয় ধরা হয়েছিল চার হাজার কোটি টাকার মতো। শেষ পর্যন্ত তা বেড়ে ১১ হাজার কোটিতে ওঠে। নকশা অনুযায়ী, সড়কটির পিচের স্থায়িত্ব হওয়ার কথা ২০ বছর। অর্থাৎ ২০৪১ সাল পর্যন্ত মহাসড়কটিতে সেভাবে মেরামত লাগার কথা নয়। অথচ চালুর এক বছরের মধ্যে মহাসড়কের ছোটখাটো রক্ষণাবেক্ষণে ১২৯ কোটি টাকার খরচ যুক্ত করে পাঁচ বছরের জন্য ঠিকাদার নিয়োগ করা হয়েছে।

টানেল

টানেলের টোল আদায় ও রক্ষণাবেক্ষণ করছে চায়না কমিউনিকেশন কনস্ট্রাকশন কোম্পানি (সিসিসিসি) লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটি টানেলের সম্ভাব্যতা যাচাই ও নির্মাণেরও দায়িত্বে ছিল। টোল আদায় ও রক্ষণাবেক্ষণে তাদের সঙ্গে পাঁচ বছরের জন্য ৬৮৪ কোটি টাকায় চুক্তি করেছে সেতু বিভাগ।

সেতু বিভাগের হিসাবে, চট্টগ্রামের টানেল থেকে গত সেপ্টেম্বরে টোল আদায় হয়েছে প্রায় আড়াই কোটি টাকা। চুক্তি অনুসারে, ঠিকাদারের পেছনে মাসে ব্যয় প্রায় সাড়ে ১১ কোটি টাকা। অর্থাৎ প্রতি মাসে গড়ে ঘাটতি হচ্ছে প্রায় সাড়ে ৯ কোটি টাকা। গত বছরের নভেম্বরে টানেলটি চালু করা হয়েছে।

শুরুতে টানেলের নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছিল ৫ হাজার কোটি টাকার কিছু বেশি। শেষ পর্যন্ত তা বেড়ে দাঁড়ায় ১০ হাজার ৬৮৯ কোটি টাকায়। এর মধ্যে ৬ হাজার ৭০ কোটি টাকা ঋণ হিসেবে নেওয়া হয়েছে চীনের এক্সিম ব্যাংক থেকে। চুক্তির পর থেকেই ঋণের সুদ ও সার্ভিস চার্জ পরিশোধ করে আসছে সরকার। সেতু কর্তৃপক্ষ সূত্র বলছে, পদ্মা ও যমুনা সেতুর ঋণের কিস্তি তারাই পরিশোধ করছে। তবে আয় দিয়ে টানেলের ঋণের কিস্তি পরিশোধ সম্ভব নয়।

টানেল পারাপারে গাড়ির টোল ২০০ টাকা। বাস-মিনিবাসের ক্ষেত্রে তা ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা। পণ্যবাহী যানের টোল ৪০০ থেকে ১ হাজার টাকা পর্যন্ত।

জিটুজি ‘অস্বচ্ছ’

বিদ্যুৎকেন্দ্র, সড়ক, সেতুসহ বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণে দরপত্র আহ্বান না করে ‘খাতিরের’ ঠিকাদারকে কাজ দেওয়ার একটি প্রবণতা ছিল বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এ কারণে অবকাঠামোগুলো নির্মাণে ব্যাপক বাড়তি ব্যয় হয়েছে। দেশের ঋণের বোঝা বেড়েছে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক সামছুল হক প্রথম আলোকে বলেন, জিটুজি পদ্ধতিতে কেনাকাটা বা ঠিকাদার নিয়োগ একটি অস্বচ্ছ প্রক্রিয়া। এতে যোগসাজশের মাধ্যমে রাজনীতিক ও প্রভাবশালী আমলাদের সুবিধা নেওয়ার সুযোগ থাকে। পদ্মা সেতু, এক্সপ্রেসওয়ে ও টানেলের টোল আদায় এবং রক্ষণাবেক্ষণে ঠিকাদার নিয়োগে সেটিই ঘটেছে।

নতুন অবকাঠামোর জন্য প্রথম পাঁচ-সাত বছরকে ‘হানিমুন পিরিয়ড’ অভিহিত করে সামছুল হক বলেন, এ সময় মেরামতের পেছনে বেশি ব্যয় না হওয়ারই কথা। এর পরও ঠিকাদারকে মেরামত বাবদ বিপুল অঙ্কের টাকা দেওয়া নানা প্রশ্নের জন্ম দেয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *