নির্বাচনি ট্রেনের যাত্রা শুরু, দ্রুত রোডম্যাপ

প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, নির্বাচন আয়োজনের লক্ষ্যে আমরা প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছি। কয়েক দিনের মধ্যে নির্বাচন কমিশন গঠন হয়ে যাবে। তার পর থেকে নির্বাচন আয়োজনের সমস্ত দায়িত্ব তাদের ওপর বর্তাবে। নির্বাচনের ট্রেন যাত্রা করেছে। এটা আর থামবে না। কিন্তু যেতে যেতে আমাদের অনেক কাজ সেরে ফেলতে হবে। এ ট্রেন শেষ স্টেশনে কখন পৌঁছাবে সেটা নির্ভর করবে কত তাড়াতাড়ি আমরা তার জন্য রেললাইনগুলো বসিয়ে দিতে পারি, আর তা হবে রাজনৈতিক দলসমূহের ঐকমত্যের মাধ্যমে।

অন্তর্বর্তী সরকারের ১০০ দিন অতিক্রম উপলক্ষে গতকাল জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে তিনি এসব কথা বলেন। ভাষণের শুরুতে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ফ্যাসিবাদবিরোধী গণ অভ্যুত্থানে নিহত সব শহীদ, আহত ও অংশগ্রহণকারীদের স্মরণ করেন। তিনি প্রতিটি হত্যার বিচার করার অঙ্গীকার করেন। পাশাপাশি গত ১৫ বছরে হওয়া সব অপকর্মের বিচার করার কথাও বলেন। পতিত স্বৈরাচার শেখ হাসিনাকে ভারত থেকে ফেরত চাইবেন বলেও তিনি জানান। নির্বাচন ছাড়া আরও গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারের ব্যাপারে ঐকমত্য গঠনের জন্য অতিরিক্ত সময় প্রয়োজন হতে পারে জানিয়ে ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, সংস্কারের জন্য নির্বাচন কয়েক মাস বিলম্বিতও করা যেতে পারে। আমরা মনে করি না যে একটি নির্বাচন কমিশন গঠন করে দিলেই নির্বাচন আয়োজনে আমাদের দায়িত্ব শেষ। রাষ্ট্রব্যবস্থায় সংস্কার আমাদের এ সরকারের অন্যতম অঙ্গীকার। এজন্য গঠিত কমিশনগুলোর কাছে আপনারা মতামত দিন, সংস্কার পাশ কাটিয়ে যাবেন না। আমরা যেন এমন একটি নির্বাচনব্যবস্থা সৃষ্টি করতে পারি যা যুগ যুগ ধরে অনুসরণ করা হবে। নির্বাচনি সংস্কারের সিদ্ধান্ত হয়ে গেলে খুব দ্রুত আপনারা নির্বাচনের রোডম্যাপ পেয়ে যাবেন। আমরা আশা করছি নির্ধারিত সময়ে, ডিসেম্বর-জানুয়ারির মধ্যেই সংস্কার কমিশনগুলো তাদের সুপারিশমালা সরকারের কাছে পেশ করতে পারবে। সবার ঐকমত্যের ভিত্তিতেই আমরা সংস্কার প্রস্তাব চূড়ান্ত করব।ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের পর দেশের সর্বত্র ছিল বিশৃঙ্খলা। কঠিন এক পরিস্থিতিতে আমাদের দায়িত্ব গ্রহণ করতে হয়েছে। সবাইকে নিয়ে স্বৈরশাসনে বিপর্যস্ত দেশটি পুনর্গঠন করতে হচ্ছে। বিপ্লব চলাকালে প্রায় দেড় হাজার ছাত্র-শ্রমিক-জনতার শহীদি মৃত্যু হয়। প্রতিদিনই তালিকায় আরও নতুন নতুন শহীদের তথ্য যোগ হচ্ছে। আহত হয়েছে ১৯ হাজার ৯৩১ জন, যাদের বিভিন্ন বিশেষায়িত হাসপাতালে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। জাতিসংঘ জুলাই-আগস্ট হত্যাকাে র তদন্তে আমাদের সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহেই তারা তাদের রিপোর্ট হস্তান্তরের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। প্রতিটি হত্যাকাে র বিচার করা হবে। এ ছাড়া অক্টোবর পর্যন্ত ১ হাজার ৬০০ গুমের তথ্য পেয়েছে গুমের ঘটনা তদন্তে গঠিত কমিশন। এসবের সঙ্গে জড়িতদের আমরা বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাবই। অভিযুক্ত যতই শক্তিশালী হোক, যে বাহিনীরই হোক তাকে ছাড় দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আমরা দায়িত্ব নেওয়ার সময় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল তলানিতে। গত তিন মাসে রিজার্ভে হাত না দিয়েই আমরা প্রায় ২ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক ঋণ শোধ করতে পেরেছি। জ্বালানি তেল আমদানিতে পুঞ্জীভূত বকেয়ার পরিমাণ ৪৭৮ মিলিয়ন ডলার থেকে কমিয়ে ১৬০ মিলিয়ন ডলারে আনতে পেরেছি।

বিশ্বব্যাংক, আইএমএফসহ বিভিন্ন দাতা সংস্থা ইতোমধ্যে ঋণ ও অনুদান হিসেবে প্রায় ৮ বিলিয়ন ডলার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, যা আমাদের ভঙ্গুর অর্থনীতি সচল করতে সক্ষম হবে। এ ছাড়া টিআইবির তথ্যানুযায়ী পতিত সরকার ও তার দোসররা প্রতি বছর দেশ থেকে ১২-১৫ বিলিয়ন ডলার পাচার করেছে। এ অর্থ ফিরিয়ে আনতে সব উদ্যোগ আমরা গ্রহণ করেছি, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সাহায্য নিচ্ছি। এটা ফিরিয়ে আনতে পারলে দেশের অর্থনীতি আরও চাঙা হবে। তিনি বলেন, দুর্নীতি ও অর্থ পাচারে অভিযুক্ত প্রভাবশালী দেড় শ ব্যক্তির তালিকা তৈরি এবং ৭৯ জনের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু হয়েছে। কালো টাকা সাদা করার বিধান বাতিল করা হয়েছে। দেশবাসীর উদ্দেশে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, এ সরকারকে ব্যর্থ করার জন্য বিশ্বব্যাপী এবং দেশের প্রতিটি স্থানে এক মহাপরিকল্পনা কার্যকর রয়েছে। পাচার করা অর্থে বলীয়ান হয়ে পতিত সরকারের পালিয়ে যাওয়া নেতারা দেশে ফেরার চেষ্টা করছেন। তারা সফল হওয়া মানে জাতির মৃত্যু। সে সুযোগ দেবেন না।

এদিকে গতকাল রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন যুক্তরাজ্যের ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ক্যাথরিন ওয়েস্ট। তিনি প্রধান উপদেষ্টাকে আশ্বস্ত করে বলেন, তার সরকার কয়েক বিলিয়ন ডলার পাচার করা অর্থ ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টাসহ অন্যান্য বিষয়ে বাংলাদেশকে পূর্ণ সহায়তা দেবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *