ঢাকায় আসার পথে জয়পুরহাটে গত ৩১ অক্টোবর বিকল হয়ে পড়ে আন্তঃনগর পঞ্চগড় এক্সপ্রেস ট্রেনের ইঞ্জিন। এতে ঢাকার সঙ্গে দেশের উত্তরাঞ্চলের রেলপথটি প্রায় ২ ঘণ্টা বন্ধ থাকে। এর আগে ১৮ অক্টোবর গফরগাঁও স্টেশনে হাওর এক্সপ্রেসের ইঞ্জিন বিকল হলে প্রায় দেড় ঘণ্টা বন্ধ থাকে ঢাকা-ময়মনসিংহ রেলপথ। চলতি বছর দেশের বিভিন্ন স্থানে এমন একাধিক ইঞ্জিন বিকল হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। রেলওয়ে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, অর্থনৈতিক আয়ু ফুরিয়ে যাওয়া ট্রেনের ইঞ্জিনগুলোয় যান্ত্রিক ত্রুটি বেশি হচ্ছে। তাই সাম্প্রতিক সময়ে রেলওয়েতে পরিচালন জটিলতা বাড়িয়েছে একের পর এক ইঞ্জিন বিকল হওয়ার ঘটনা।
বাংলাদেশ রেলওয়ের তথ্যানুযায়ী, দেশে বিদ্যমান ৫১ শতাংশ লোকোমোটিভের (ইঞ্জিন) অর্থনৈতিক আয়ু নেই। একইভাবে আয়ুষ্কাল ফুরিয়েছে ৪১ শতাংশ ক্যারেজ (কোচ) ও ৬২ শতাংশ ওয়াগনের। পুরনো হয়ে যাওয়া এসব ইঞ্জিন, কোচ ও ওয়াগন দিয়ে ট্রেন পরিচালনায় প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা। আবার দুর্ঘটনাকবলিত ট্রেন উদ্ধারেও লাগছে অতিরিক্ত সময়। এর জন্য দায়ী পুরনো হয়ে যাওয়া উদ্ধারকারী ট্রেন (রিলিফ ক্রেন)। সংস্থাটির বহরে থাকা ৬৩ শতাংশ উদ্ধারকারী ট্রেনেরই ফুরিয়ে গেছে অর্থনৈতিক আয়ু।
ইঞ্জিন, যাত্রীবাহী কোচ, পণ্যবাহী ওয়াগন, ডেমু, লাগেজ ভ্যান ও রিলিফ ক্রেন—ছয় ধরনের রোলিংস্টক রয়েছে রেলে। মোট রোলিংস্টকের পরিমাণ ৬ হাজার ৭১টি। এর মধ্যে অর্থনৈতিক আয়ু ফুরিয়েছে ৩ হাজার ২৪৯টি রোলিংস্টকের। অর্থাৎ রেলের বহরে থাকা প্রায় ৫৪ শতাংশ রোলিংস্টকেরই নেই অর্থনৈতিক আয়ু।
রেলের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সংস্থাটির বহরে বর্তমানে ইঞ্জিন রয়েছে ২৯৭টি। এর মধ্যে ১৬৭টি মিটার গেজ, বাকিগুলো ব্রড গেজ। রেলের একটি ইঞ্জিনের অর্থনৈতিক আয়ুষ্কাল ধরা হয় ২০ বছর। অর্থনৈতিক আয়ুষ্কাল রয়েছে রেলওয়েতে এমন ইঞ্জিনের সংখ্যা ১৪৭। অন্যদিকে ৫০টি ইঞ্জিনের বয়স ২১ থেকে ৩০ বছর। ৩১ থেকে ৪০ বছর বয়সী ইঞ্জিন রয়েছে ১৬টি। আর ৮৪টি ইঞ্জিনের বয়স ৪০ বছর পেরিয়ে গেছে।
শুধু ইঞ্জিন নয়, যাত্রীবাহী কোচেও নানা ধরনের যান্ত্রিক ত্রুটি থাকায় পরিচালন জটিলতায় পড়ছে রেল। এসব ত্রুটি ঠিক করতে গিয়ে কখনো শিডিউল এলোমেলো হয়ে পড়ছে। আবার কখনো ত্রুটি থাকা কোচ রেখেই ছেড়ে যাচ্ছে ট্রেন। ফলে যাত্রীরা পড়ছে দুর্ভোগে।
সাধারণত ট্রেনের একটি যাত্রীবাহী কোচের অর্থনৈতিক আয়ু ধরা হয় ৩৫ বছর। রেলের বহরে বর্তমানে যাত্রীবাহী কোচ রয়েছে ১ হাজার ৯০২টি। এর মধ্যে ৩৫ পেরোনো কোচের সংখ্যা ৭৮৪। ১৬৩টি কোচের বয়স ৩১-৩৫ বছরের মধ্যে। ২১ থেকে ৩০ বছর বয়সী কোচ আছে ৩৫টি। ১১ থেকে ২০ বছর বয়সী কোচের সংখ্যা ১৩১। বাকি ৭৬৯টি কোচের বয়স এক থেকে ১০ বছর।
রেলের রোলিংস্টক বহরের মধ্যে বর্তমানে সবচেয়ে ভালো অবস্থায় রয়েছে লাগেজ ভ্যান। সদ্য কেনা ১২৫টি ভ্যান বহরে যোগ করে পুরনো সব লাগেজ ভ্যান তুলে দিয়েছে সংস্থাটি। বিপরীতে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় আছে ওয়াগন বহর। চলতি বছরের ২৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পাওয়া হিসাব অনুযায়ী, রেলে ওয়াগনের সংখ্যা ৩ হাজার ৭১১। সাধারণত একটি লাগেজ ভ্যানের অর্থনৈতিক আয়ু ধরা হয় ৪০ বছর। রেলওয়েতে ৪০ পেরোনো ওয়াগনের সংখ্যা ২ হাজার ৩০৫। এর মধ্যে ১ হাজার ৭৬টি ওয়াগনের বয়স ৪০-৪৫ বছর। আর ৪৫ বছর পেরিয়ে গেছে এমন ওয়াগনের সংখ্যা ১ হাজার ২২৯।
বাংলাদেশ রেলওয়ের নেটওয়ার্কভুক্ত রেলপথের একটা বড় অংশ পুরনো। এসব পথে পুরনো রোলিংস্টক পরিচালনা করতে গিয়ে প্রায়ই ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটছে। কোনো ট্রেন দুর্ঘটনায় পড়লে সেটিকে উদ্ধারে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিতে গিয়েও জটিলতায় পড়ছে রেল। কারণ উদ্ধারকারী ট্রেনগুলোও বেশ পুরনো।
রেলওয়ের তথ্য বলছে, সংস্থাটি বহরে বর্তমানে ১৬টি উদ্ধারকারী ট্রেন রয়েছে। সাধারণত একটি উদ্ধারকারী ট্রেনের আয়ু ধরা হয় ২০ বছর। যদিও রেলের বহরে থাকা ১০ উদ্ধারকারী ট্রেনেরই আয়ুষ্কাল পেরিয়ে গেছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক সরদার সাহাদাত আলী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘পুরনো রোলিংস্টকের কারণে ট্রেন পরিচালনায় আমরা বেশ জটিলতায় পড়ছি। জটিলতা নিরসনের জন্য একাধিক প্রকল্পের মাধ্যমে ইঞ্জিন, কোচ ও ওয়াগন কেনার উদ্যোগ আমাদের রয়েছে। ক্রয় প্রক্রিয়াধীন থাকা রোলিংস্টক বহরে যোগ হলে আর সমস্যা হবে না।’