বিপুল অংক ব্যয়ে নির্মিত মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ কেন্দ্র এখন বসিয়ে রাখতে হচ্ছে

বাংলাদেশে নির্মিত কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ব্যয়বহুল প্রকল্প মাতারবাড়ী তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র। কক্সবাজারের মহেশখালীর মাতারবাড়ীতে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ব্যয়বহুল বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি নির্মাণ করা হয়েছে জাপানি ঋণে। প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয় প্রায় ৫৭ হাজার কোটি টাকা। ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট সক্ষমতার আল্ট্রাসুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তির তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রটিতে উৎপাদন এখন বন্ধ। কয়লা আমদানি করতে না পারায় এখান থেকে বিদ্যুৎ কিনতে পারছে না বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি)। প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, প্রয়োজনীয় কয়লা আমদানি করে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি চালু করতে সময় লেগে যেতে পারে চলতি মাসের শেষ নাগাদ।

কয়লা সংকটের কারণে গত ২৫ অক্টোবর বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির উৎপাদন পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। বর্তমানে এর দুটি ইউনিটই অলস বসিয়ে রাখা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, মাতারবাড়ী কয়লাবিদ্যুৎ কেন্দ্রটি কমিশনিংয়ের পর থেকে এর কয়লা আনা হচ্ছিল জাপানের সুমিতমো করপোরেশনের মাধ্যমে। গত আগস্টে জাপানি প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে চুক্তি শেষ হয়ে যায়। এরপর নতুন টেন্ডারের মাধ্যমে পরবর্তী সরবরাহকারী কোম্পানি নির্বাচনের কথা ছিল। কিন্তু কেন্দ্রটিতে কয়লা সরবরাহের কাজ পেতে ঠিকাদারি বেশ কয়েকটি বাংলাদেশী প্রতিষ্ঠান দুই মাস ধরে নানাভাবে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা চালিয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এতে বিলম্বিত হয় কেন্দ্রটির কয়লা আমদানিসংক্রান্ত চুক্তি সম্পাদনের প্রক্রিয়া। আবার বিদ্যুৎ প্রকল্পের শীর্ষ কয়েক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ ও দুর্নীতি মামলা চলমান রয়েছে। গোটা প্রক্রিয়াটি আরো দীর্ঘায়িত হওয়ার পেছনে এগুলোরও প্রভাব পড়েছে বলে বিদ্যুৎ কেন্দ্রসংশ্লিষ্ট নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে।

সঞ্চালন সংস্থা পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশের (পিজিসিবি) ওয়েবসাইটে উল্লেখ রয়েছে, কয়লা সংকটের কারণে মাতারবাড়ী তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রটি বন্ধ রাখতে হচ্ছে। যদিও বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তাদের দাবি, তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রটি রক্ষণাবেক্ষণ কাজের কারণে বন্ধ রয়েছে, কয়লাসংক্রান্ত কোনো সংকট নেই।

মাতারবাড়ী তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রটি পরিচালনা করছে কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি লিমিটেড (সিপিজিসিবিএল)। কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) মো. নাজমুল হক বণিক বার্তাকে বলেন, ‘মাতারবাড়ী তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র বর্তমানে মেইনটেন্যান্সে রয়েছে। নভেম্বরের শেষ নাগাদ বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি পুনরায় উৎপাদনে নিয়ে আসার পরিকল্পনা করা হয়েছে। বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির দুটি ইউনিট বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন শুরু করেছে।’

তবে নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে সিপিজিসিবিএলের আরেক কর্মকর্তা বণিক বার্তাকে বলেন, ‘মাতারবাড়ী তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রটি কয়েক মাস ধরেই কয়লা সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। প্রয়োজনীয় কয়লা না থাকায় কেন্দ্রটির একটি ইউনিট চালানো হচ্ছিল। কেন্দ্রের কয়লা সরবরাহের জন্য ঠিকাদার নির্বাচন (দরপত্রের মাধ্যমে) নিয়ে বেশ কয়েকটি দরদাতা কোম্পানির মধ্যে জটিলতা তৈরি হয়। দরপত্রসংক্রান্ত বিষয়টি বিলম্বিত হওয়ায় বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি কয়লা সংকটে পড়ে। একটি ইউনিট দিয়ে বন্ধ হওয়ার আগে অল্প করে বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছিল, এক পর্যায়ে সেটিও বন্ধ হয়ে যায়।’

সার্বক্ষণিক উৎপাদন ও ব্যয় সাশ্রয়ের পরিকল্পনাকে সামনে রেখে মাতারবাড়ীর মতো বৃহদায়তনের বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে অনুমোদন দিয়েছিল বিগত সরকার। জ্বালানি বিশেষজ্ঞসহ সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, বড় অংকের ঋণ করে এগুলো নির্মাণ করা হলেও এসব কেন্দ্রের জ্বালানি ও এর জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের সংস্থান নিয়ে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার অভাব ছিল। এছাড়া দেশের ব্যাংক ব্যবস্থার দুর্বলতাও এখন বিষয়টিকে আরো জটিল করে তুলছে। সবসময় চালু রাখা ছাড়া বিপুল অংক ব্যয়ে নির্মিত বেজলোড (সার্বক্ষণিক চালু রাখতে হয় এমন) বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির অর্থনৈতিক সুফল পাওয়া যাবে না বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

বিদ্যুৎ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, মাতারবাড়ী প্রকল্পে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের মোট প্রাক্কলিত ব্যয় ৫৬ হাজার ৯৯৩ কোটি ৯০ লাখ টাকা। এর মধ্যে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) প্রকল্প ঋণ রয়েছে ৪৭ হাজার ৯৪৫ কোটি টাকা। বাংলাদেশ সরকারের অর্থায়ন ৭ হাজার ২১১ কোটি টাকা। আর সিপিজিসিবিএলের নিজস্ব তহবিল ১ হাজার ৫২৮ কোটি টাকা। সিপিজিসিবিএলের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এ প্রকল্পের মোট ভৌত অগ্রগতি হয়েছে ৮৯ দশমিক ২০ শতাংশ। আর বন্দর ও বিদ্যুৎ কেন্দ্রের অগ্রগতি শতভাগ।

বুয়েটের অধ্যাপক ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ম. তামিম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘সার্বক্ষণিক চালু রাখার পরিকল্পনা থেকেই দেশে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের অনুমোদন দেয়া হয়েছিল। অথচ বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর জন্য এখন ঠিকমতো জ্বালানির জোগান নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। বর্তমানে এলএনজির চেয়ে কয়লার দাম তুলনামূলক কম হলেও আমদানির মতো পর্যাপ্ত অর্থ নেই। ৭০-৭৫ শতাংশ প্লান্ট ফ্যাক্টরে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো চলার কথা, যেখানে চলছে ৩৫-৪০ শতাংশ প্লান্ট ফ্যাক্টরে। এতে বিপিডিবির ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ ব্যয় বাড়ছে। তবে এ পরিস্থিতি হয়েছে মূলত দেশে ব্যাংক ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়া এবং অর্থনৈতিক অনাচারের কারণে, যার সামগ্রিক প্রভাব পড়ছে দেশের জ্বালানি খাতে।’

চলতি বছরের ১৪ সেপ্টেম্বর মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ প্রকল্প পরিদর্শনে যান অন্তর্বর্তী সরকারের বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান। সে সময় তিনি এ বিদ্যুৎ কেন্দ্রকে ‘প্রকল্প বিলাস’ বলে অভিহিত করেন। এ প্রকল্প থেকে সাধারণ মানুষ খুব বেশি উপকৃত হচ্ছে না বলে সে সময় মন্তব্য করেন তিনি। উপদেষ্টার বক্তব্যে উঠে আসে, মূল প্রকল্পের ধারণা অনুসারে গভীর সমুদ্রবন্দর, শিল্প-কারখানা, রেল ও সড়ক সংযোগ নিশ্চিত না করেই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি নির্মাণ করা হয়েছে।

বর্তমান সরকার ভবিষ্যতে এ ধরনের বিলাসী প্রকল্প গ্রহণ থেকে সরে আসবে বলেও সে সময় জানান তিনি।

বর্তমানে শুধু মাতারবাড়ী নয়, অন্যান্য কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রও জ্বালানি সংকটে রয়েছে। বর্তমানে বরিশাল ৩০৭ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি বন্ধ রয়েছে। এছাড়া বেসরকারি বৃহৎ সক্ষমতার কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের একটি ইউনিট বন্ধ রয়েছে। রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের একটি ইউনিট উৎপাদনে নেই। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বেশির ভাগ জ্বালানি ও অর্থসংক্রান্ত জটিলতায় বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারছে না।

মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ থাকার কারণ জানতে চাইলে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মো. রেজাউল করিম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি মূলত কয়লা সংকটের কারণে বন্ধ রয়েছে। কয়লা আমদানির জন্য টেন্ডার করে চূড়ান্তভাবে কোম্পানি নির্বাচন করা হয়েছে। দুই পক্ষের সঙ্গে চুক্তি সই সম্পন্ন হয়েছে। ২০-২১ নভেম্বর বিদ্যুৎ কেন্দ্রে কয়লা চলে আসবে। মাসের শেষ নাগাদ উৎপাদন কার্যক্রম পুনরায় শুরু হবে।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *