বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট নাইমা হক ও ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তামান্না-ই-লুৎফী জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে যোগ দেন ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে। বাংলাদেশ থেকে জাতিসংঘ মিশনে যাওয়া প্রথম দুই নারী কমব্যাট পাইলট তারা। মিশনে তাদের অবদান বেশ প্রশংসিত হয়। সে সময় তাদের অবদান স্বীকার করে জাতিসংঘের পক্ষ থেকে বলা হয়, ‘কঙ্গোর নারীদের কাছে রোল মডেলে পরিণত হয়েছেন এ দুই নারী পাইলট। প্রতিদিন তাদের অনেক বিপজ্জনক বাধা ডিঙোতে হয়। তবে তারা সব কাজই সফলভাবে শেষ করেন।’
ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট নাইমা হক ও তামান্না-ই-লুৎফীর মতো বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর উল্লেখযোগ্যসংখ্যক নারী সদস্য জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা রেখে চলেছেন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে জাতিসংঘ মিশনে বাংলাদেশী নারীদের অংশগ্রহণ বেড়েছে।
ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ ইনিশিয়েটিভের (ডিআরআই) এক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালের মধ্যেই জাতিসংঘের শান্তি মিশনে নিয়োজিত সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে নারী সদস্যের হার ১১ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। তবে ২০২০ সালে সশস্ত্র এবং পুলিশ ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ জাতিসংঘ মিশনে কর্মরত বাংলাদেশীদের মধ্যে নারীর হার ৪ শতাংশ ছিল বলে জেনেভা সেন্টার ফর সিকিউরিটি সেক্টর গভর্ন্যান্সের এক হিসাবে উঠে এসেছে। আর শুধু সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের হিসাব করলে এ হার আরো অনেক বেশি।
বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীর থেকে এখন পর্যন্ত ৯৬২ জন নারী শান্তিরক্ষী জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে অংশগ্রহণ করেছে। বর্তমানে ৪১৫ জন নারী সদস্য বিভিন্ন শান্তিরক্ষা মিশনে নিয়োজিত আছেন। এর মধ্যে সেনাবাহিনী থেকে সর্বাধিক নারী রয়েছেন। অর্থাৎ ৩৮৮ জন সেনাবাহিনী থেকে। এছাড়া নৌবাহিনী থেকে ১২ জন ও বিমান বাহিনী থেকে ১৫ জন মিশনে অংশ নিচ্ছেন।
বিভাগটির তথ্যসূত্রে আরো জানা যায়, শান্তিরক্ষা মিশনগুলোয় কর্মরত স্টাফ অফিসার ও মিলিটারি অবজারভারদের মধ্যে নারীর হার ১৮ শতাংশে উন্নীত করার পরিকল্পনা রয়েছে জাতিসংঘের। বাংলাদেশ এরই মধ্যে প্রায় ১৮ শতাংশের কাছাকাছি পৌঁছেছে। সামনের দিনে এটি পূরণ হয়ে আরো বাড়বে। এছাড়া ২০১৯ সালের শুরু থেকেই বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ব্যাটালিয়নে ‘ফিমেল এনগেজমেন্ট টিম’ অন্তর্ভুক্ত করা শুরু করেছে।
জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে নারীদের অংশগ্রহণ প্রসঙ্গে সাবেক সামরিক কর্মকর্তা মেজর জেনারেল (অব.) ফজলে এলাহি আকবর বণিক বার্তাকে বলেন, ‘যুদ্ধবিধ্বস্ত জায়গায় জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশন হয়। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো যেকোনো যুদ্ধবিধ্বস্ত জায়গায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় নারী ও ছোট শিশুরা। এর কারণ হলো এসব যুদ্ধবিধ্বস্ত জায়গায় নারীরা যুদ্ধে লিপ্ত হয়। অনেকে আবার মারা যায় তাদের কোনো হদিস পাওয়া যায় না। এই যে একটি পরিবার তারা পেছনে রেখে গেল; সেই পরিবারের বোঝা ওই মেয়েদের, মাদেরই কিন্তু বহন করতে হয়। যেখানে যুদ্ধের পর সবকিছু ধ্বংস হয়ে যায়; চাকরির কোনো সুযোগই থাকে না; সেখানে নারী ও শিশুরা বাস্তুহারা ও দিশাহারা হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় তাদের পাশে দাঁড়িয়ে এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য সবচেয়ে ভালো হলো সামরিক বাহিনীর নারী অফিসার ও সৈনিকরা। জাতিসংঘের দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই কিন্তু নারীদের যুক্ত করায় জোর দিয়েছে এবং সেটি ১৮ শতাংশ নিশ্চিত করতে চাচ্ছে। আমাদের দেশ থেকে পুরুষরা সেনাবাহিনীতে কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। কিন্তু মানসিক সাপোর্ট দেয়া এবং নানাভাবে নারীদের খুব কাছে গিয়ে তাদের সমস্যাটি তাদের মতো করে বোঝা এবং খুব কাছে থেকে সমাধান করা একজন নারীর পক্ষে যেমন সম্ভব, একজন পুরুষের পক্ষে কিন্তু এটি সম্ভব না। সেজন্য বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর নারীদের এ ভূমিকাটি চালু রাখা উচিত। সে সঙ্গে এক্ষেত্রে তাদের লিড রোলে রাখা উচিত।’
জাতিসংঘ স্বীকৃত শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে ১৯৮৮ সালে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীদের প্রথম পদযাত্রা শুরু। ১৯৮৮ সালে ইরান-ইরাক (ইউনিমগ) শান্তি মিশনে যোগদানের মাধ্যমে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ১৫ জন চৌকস অফিসার প্রথম জাতিসংঘের পতাকাতলে একতাবদ্ধ হয়। তবে নারীদের যাত্রাটি শুরু হয় আরো অনেক পরে। প্রথমবারের মতো ২০০৯ সাল থেকে সশস্ত্র বাহিনীর নারী সদস্যরা জাতিসংঘ মিশনে অংশগ্রহণ করে আসছেন।
শান্তিরক্ষা মিশনে বিভিন্ন দেশ থেকে আসা নারীদের অংশগ্রহণ ক্রমান্বয়ে বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে জাতিসংঘের। অ্যাকশন ফর পিসকিপিংয়ের ২০১৯ সালের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সালে বিভিন্ন দেশের সামরিক বাহিনী থেকে আগত মিলিটারি অবজারভার এবং স্টাফ অফিসারদের মধ্যে নারী ছিল ৯ শতাংশ। ২০১৯ সালে এ হার বেড়ে দাঁড়ায় ১৬ দশমিক ৭ শতাংশে। ২০২৮ সালের মধ্যে সামরিক বাহিনীগুলো থেকে নারীর অংশগ্রহণের হার ২৫ শতাংশে উত্তরণের টার্গেট রয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের নারীদের অংশগ্রহণের হার বেড়েছে।