এক সপ্তাহেই বাড়ল ১২ পণ্যের দাম

নিত্যপণ্যের দামের চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে সাধারণ মানুষ। চাল, আটা, পেঁয়াজ, ভোজ্যতেল থেকে শুরু করে এমন কোনো নিত্যপণ্য নেই, যার দামে স্বস্তি আছে।

সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে, এক সপ্তাহে, অর্থাৎ ৭ থেকে ১৪ অক্টোবরের মধ্যে ১২টি নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে। এ তালিকায় রয়েছে সয়াবিন তেল, পাম তেল, চালের কুঁড়ার তেল বা রাইস ব্র্যান অয়েল, আলু, ছোলা, পেঁয়াজ, রসুন, জিরা, দারুচিনি, ধনে, গরুর মাংস ও ডিম।

ডিমের দাম নতুন করে বেড়েছে ডজনপ্রতি ১২ টাকা। বাজার ঘুরে দেখা গেছে, দাম উঠেছে ডজনপ্রতি ১৮০–২০০ টাকায়। দর কমাতে বাজারে অভিযান শুরুর পর ডিম বিক্রিই বন্ধ রেখেছে কিছু কিছু আড়ত। এতে সরবরাহ সংকট তৈরি হয়েছে। অনেক বাজারে ডিমই পাওয়া যাচ্ছে না।

খোলা সয়াবিন তেলের দাম লিটারে ১ টাকা বেড়েছে এক সপ্তাহে। এ নিয়ে এক মাসে বাড়ল ৪ টাকা। আলুর দাম কেজিতে ৫ টাকা, পেঁয়াজ ৫ টাকা এবং গরুর মাংসের দাম কেজিপ্রতি ৫০ টাকা বাড়তি।

টিসিবির তালিকায় শাকসবজির দাম উল্লেখ থাকে না। যদিও এখন বাজারে সবচেয়ে চড়া দাম শাকসবজির। একেকটি শাকের আঁটি এখন ৩০-৫০ টাকা। বেশির ভাগ সবজির কেজি ৮০ টাকা থেকে শুরু। কোনো কোনো সবজি বিক্রি হচ্ছে ১৫০ টাকা কেজি।

টিসিবির হিসাবে, এক সপ্তাহে সাতটি নিত্যপণ্যের দাম কিছু কিছু কমেছে। এর মধ্যে রয়েছে মসুর ডাল, মুগ ডাল, আদা, এলাচি, খাসির মাংস, দেশি মুরগি ও চিনি। এসব পণ্যের দাম আগেই অনেক চড়া ছিল। ফলে সামান্য কমলেও তাতে স্বস্তি ফেরেনি।

দাম কমাতে সরকার কিছু পণ্য আমদানি ও শুল্ক–কর কমানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। তবে এর সুফল কতটা পাওয়া যাবে, সেই প্রশ্ন রয়েছে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, আমদানি ও শুল্ক কমানোর পদক্ষেপগুলো নিতে দেরি করে ফেলেছে সরকার। বাজার পরিস্থিতি সামলাতে নতুন সরকারকে শুরু থেকেই উদ্যোগী হওয়া দরকার ছিল। যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, সেগুলোর সুফল যাতে পাওয়া যায়, সে ক্ষেত্রে নজরদারি থাকতে হবে।

ডিমের দাম আরও বেড়েছে

পাতে মাছ-মাংস তোলা যাঁদের জন্য একটু কষ্টকর, তাঁরা পুষ্টির চাহিদা মেটান ডিম দিয়ে। স্বল্প আয়ের মানুষের প্রাণিজ আমিষের বড় উৎসই হচ্ছে ডিম। সেই ডিমের দামও এখন সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। পাশাপাশি নতুন সংকট হচ্ছে, পুরোনো কৌশলে বাজারে অভিযান চালাতে গিয়ে ডিমের সরবরাহব্যবস্থাতেই বিঘ্ন তৈরি হয়েছে।

রাজধানীর তেজগাঁওয়ের আড়তে গত রবি ও সোমবার রাতে ডিমের ট্রাক আসেনি। ফলে তৈরি হয় ডিমের সরবরাহ সংকট। যে কারণে গত সোমবার ও গতকাল মঙ্গলবার ফার্মের মুরগির ডিম কারওয়ান বাজারে বিক্রি হতে দেখা যায়নি।

একই দৃশ্য রাজধানীর কৃষি মার্কেটেও। এ মার্কেটে ডিমের সরবরাহ আসে কাপ্তান বাজার থেকে। প্রথম আলোর পক্ষ থেকে সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, কৃষি মার্কেটের বেশির ভাগ দোকানে ডিম নেই। একটি দোকানে ১৮০ টাকা ডজন ডিম বিক্রি হয়েছে। বিক্রেতারা জানান, কাপ্তান বাজার থেকে ডিম কেনা যায়নি।

কৃষি মার্কেটের দোকানি আরশাদ হোসেন বলেন, দুই দিন দোকানে ডিম রাখা হয়নি। ডিম রাখলে ১৮০ টাকা ডজন বিক্রি করতে হয়। এ দামে বিক্রি করতে গেলে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর জরিমানা করে। ডিমের দাম না কমা পর্যন্ত তিনি বিক্রির সাহস করছেন না।

বড় বাজারে ১৮০ টাকা দরে পাওয়া গেলেও সোমবার রাত ও গতকাল পাড়া–মহল্লার মুদিদোকানে ডিমের দাম ডজন ১৯০ থেকে ২০০ টাকায় উঠে যায়।

এদিকে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের কার্যালয়ে ডিমের দাম ও সরবরাহ নিয়ে আয়োজিত এক সভায় গতকাল সিদ্ধান্ত হয় যে এখন থেকে ডিম উৎপাদক বড় কোম্পানি ও ছোট খামারিরা সরকার নির্ধারিত দামে সরাসরি ঢাকার আড়তে ডিম পাঠাবেন, মাঝখানে কোনো মধ্যস্বত্বভোগী থাকবে না। এর ফলে পাইকারি বিক্রেতারাও সরকার নির্ধারিত দামে খুচরা বিক্রেতাদের কাছে ডিম বিক্রি করবেন।

সভায় কাজী ফার্ম, প্যারাগন, সিপিসহ বড় করপোরেট ব্যবসায়ী, খামারি এবং তেজগাঁও ও কাপ্তানবাজারের ব্যবসায়ীরা উপস্থিত ছিলেন।

সম্প্রতি কৃষি বিপণন অধিদপ্তর ডিমের যৌক্তিক দাম নির্ধারণ করে দেয়। নির্ধারিত দাম অনুসারে, প্রতিটি ডিমের দাম উৎপাদন পর্যায়ে ১০ টাকা ৫৮ পয়সা, পাইকারি পর্যায়ে ১১ টাকা শূন্য ১ পয়সা ও খুচরা পর্যায়ে ১১ টাকা ৮৭ পয়সা (ডজন ১৪২ টাকা ৪৪ পয়সা) হওয়ার কথা। ভোক্তা অধিদপ্তরের সঙ্গে বৈঠকের পর আড়তদারেরা জানান, তাঁরা ডিম বিক্রি শুরু করবেন।

সভা শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন ভোক্তা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. আলীম আক্তার খান। তিনি জানান, নতুন সিদ্ধান্তের ফলে দু-তিন দফা হাতবদল কমবে। ফলে ক্রেতারা কম দামে ডিম কিনতে পারবেন। তিনি বলেন, ‘নতুন এ পদ্ধতিতে দুই সপ্তাহ পর্যন্ত বিক্রি চলবে। এ সময়ে আমরা পর্যালোচনা করে দেখব যে এই পদ্ধতি ভবিষ্যতে চলমান রাখা যাবে কি না।’

এদিকে রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং আয়োজিত এক সংবাদ বিফ্রিংয়ে গতকাল জানানো হয়, ডিম আমদানিতে বিদ্যমান শুল্ক–কর ৩৩ থেকে কমিয়ে ১৩ শতাংশ করার পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। উল্লেখ্য, গত সপ্তাহে সরকার সাড়ে চার কোটি ডিম আমদানির অনুমতি দেয়। যদিও তা আসা শুরু হয়নি।

ভোজ্যতেলেও করছাড় আসছে

আন্তর্জাতিক বাজারে কয়েক মাস ধরে সয়াবিন তেল ও পাম তেলের দাম বাড়ছে বলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে সম্প্রতি এক চিঠিতে জানিয়েছে বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যাসোসিয়েশন। সমিতিটি মন্ত্রণালয়কে জানায়, বিশ্ববাজারে অপরিশোধিত সয়াবিন তেল ১৪ দশমিক ৮ শতাংশ এবং পাম তেল ১৮ দশমিক ৬৮ শতাংশ বেড়েছে। এ কারণে দেশের বাজারে তারা দুই ধরনের তেলের দাম সমন্বয় করতে চায়। সর্বশেষ সমন্বয় করা হয়েছিল গত ১৮ এপ্রিল।

তবে বিকল্প প্রস্তাবও রয়েছে সমিতিটির। সচিবালয়ে গতকাল অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে বৈঠক করে সমিতি জানায়, স্থানীয় পর্যায়ে দাম তারা বাড়াবে না, যদি সরকার আমদানি পর্যায়ে বিদ্যমান শুল্ক ১৫ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশে নামিয়ে আনে। শুধু তা–ই নয়, স্থানীয় উৎপাদন ও ব্যবসায়ী পর্যায়ে সব ধরনের শুল্ক প্রত্যাহারও চায় তারা। জানা গেছে, স্থানীয় পর্যায়ে কর রয়েছে ৫ শতাংশ।

বৈঠকে বাণিজ্যসচিব মোহা. সেলিম উদ্দিন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান, বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের চেয়ারম্যান মইনুল খানসহ ভোজ্যতেল পরিশোধন কারখানাগুলোর মালিকপক্ষ উপস্থিত ছিল।

বৈঠকের পর গতকালই বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এনবিআরে প্রস্তাবটি পাঠিয়ে দিয়েছে। ট্যারিফ কমিশনই করছাড়ের সুপারিশ করেছিল।

এনবিআরের চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান গত রাতে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রস্তাব পেয়েছি। শুল্ক কমানোর বিষয়টি পর্যালোচনা করার কাজও শুরু করেছি। শিগগির এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি হবে।’

সুলভে ১০ পণ্য বিক্রির উদ্যোগ

রাজধানীর সচিবালয় এলাকায় খাদ্য ভবনের সামনে গতকাল কৃষি ওএমএস (ওপেন মার্কেট সেল) কর্মসূচির উদ্বোধন করেন অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ। কৃষি ও খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় ন্যায্যমূল্যে ডিম, আলু, পেঁয়াজ ও সবজি জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে এ উদ্যোগ নেওয়া হয় বলে জানানো হয়।

উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘সরকারি উদ্যোগে সুলভ মূল্যে ভোক্তারা এখন ১০টি কৃষিপণ্যও পাবেন। এতে জনগণের সুবিধা হবে। ভোক্তারা যাতে সুলভ মূল্যে সবকিছু পান, সে কারণেই আমাদের এই প্রচেষ্টা।’

এ কর্মসূচির আওতায় একজন গ্রাহক ৩০ টাকায় এক কেজি আলু, ১৩০ টাকায় এক ডজন ডিম, ৭০ টাকায় এক কেজি পেঁয়াজ, ২০ টাকায় ১ কেজি কাঁচা পেঁপে ও পাঁচ কেজি বিভিন্ন ধরনের সবুজ শাকসবজি প্যাকেজ আকারে (একসঙ্গে) কিনতে পারবেন।

জানা গেছে, প্রাথমিকভাবে রাজধানীর ২০টি জায়গায় ট্রাক সেলের (ট্রাকে করে বিক্রি) মাধ্যমে এসব কৃষিপণ্য বিক্রি করা হবে। জায়গাগুলো হচ্ছে সচিবালয় এলাকার খাদ্য ভবন, মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ, মিরপুর-১০, বাসাবো, বছিলা, রায়ের বাজার, রাজারবাগ, মুগদা উত্তর, মুগদা দক্ষিণ, পলাশী মোড়, হাজারীবাগ, মোহাম্মদপুর, গাবতলী, মহাখালী বাসস্ট্যান্ড, বেগুনবাড়ি, উত্তর খান, দক্ষিণ খান, কামরাঙ্গীরচর, রামপুরা ও জিগাতলা।

পোশাকশ্রমিকদের জন্য ন্যায্যমূল্যে পণ্য

এদিকে পোশাকশ্রমিকদের জন্য ন্যায্যমূল্যে টিসিবির পণ্য বিক্রি কার্যক্রম শুরু হচ্ছে আজ বুধবার। শ্রম ও কর্মসংস্থান এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের যৌথ উদ্যোগ এটি। এ কর্মসূচির আওতায় পোশাকশ্রমিকেরাও ভর্তুকি মূল্যে তেল, ডাল ও চাল কিনতে পারবেন। আজ সকাল ১০টায় গাজীপুরের টঙ্গীতে অবস্থিত জাবের অ্যান্ড জুবায়ের ফেব্রিকস কারখানার সামনে এ কার্যক্রমের উদ্বোধন করবেন শ্রম ও কর্মসংস্থান উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া।

টিসিবি সূত্রে জানা গেছে, আগামীকাল সীমিত পরিসরে এ কর্মসূচি চালু করা হবে। এতে তৈরি পোশাকশিল্পের শ্রমিকদের এক হাজার পরিবারের মধ্যে পণ্য বিতরণ করা হবে। এর আওতা পর্যায়ক্রমে বাড়ানো হবে। দুই লিটার ভোজ্যতেল, দুই কেজি ডাল ও পাঁচ কেজি চাল প্যাকেজ আকারে পাবেন শ্রমিকেরা। বর্তমানে দেশে ফ্যামিলি কার্ডধারী এক কোটি নিম্ন আয়ের পরিবারের কাছে প্রতি মাসে ভর্তুকি মূল্যে পণ্য বিক্রি করছে টিসিবি। পরিবার কার্ডধারী একজন ভোক্তা সর্বোচ্চ দুই লিটার ভোজ্যতেল, দুই কেজি মসুর ডাল ও পাঁচ কেজি চাল কিনতে পারেন।

সরবরাহ বাড়ানোর তাগিদ

দাম কমাতে এর আগে সরকার পেঁয়াজ ও আলুর শুল্ককর কমিয়েছিল। তখন দামও কিছুটা কমেছিল। পরে আবার বেড়েছে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, সরবরাহ বাড়িয়ে বাজারে প্রভাব ফেলতে হবে।

নিত্যপণ্যের দাম ও সরকারের উদ্যোগ নিয়ে জানতে চাইলে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সাবেক সভাপতি গোলাম রহমান প্রথম আলোকে বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আগের সরকার উদ্ভট সব চিন্তা দিয়ে চলত। অনেক টাকা ছাপিয়ে ওই সরকার বাজারে ছেড়েছে, যার খারাপ ফল এখনো আছে। তবে বর্তমান সরকার বাজার ব্যবস্থাপনার বিষয়গুলো বুঝে-শুনেই পদক্ষেপ নিচ্ছে বলে মনে হচ্ছে।

গোলাম রহমান বলেন, চাঁদাবাজি ও সমাজে অস্থিরতার কারণেও নিত্যপণ্যের দাম বাড়ে। দেশের সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করাটা তাই জরুরি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *