মোবাইল ইন্টারনেট সেবায় ডাউনলোডে সামান্য গতি বাড়লেও আপলোডে কমেছে

জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের আগে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলাকালে দেশের ইন্টারনেট সেবা বন্ধ রাখা হয় দুই সপ্তাহের মতো। ওই সময় থেকে ইন্টারনেট স্পিডের উন্নতি হয়েছে সামান্যই। আবার একই সঙ্গে কমেছে ইন্টারনেট পরিষেবার গুণগত মানও। পর্যাপ্ত গতি না পাওয়ার অভিযোগ করছেন গ্রাহকরা। গ্লোবাল স্পিডটেস্ট ওকলা ইনডেক্স অনুযায়ী, জুলাই-আগস্টের পর দেশে মোবাইল ইন্টারনেট সেবায় ডাউনলোড স্পিডে কিছুটা উন্নতি দেখা গেলেও আপলোড স্পিড কমেছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জুলাই-আগস্টে দীর্ঘ সময় দেশের ইন্টারনেট সেবা ব্যাহত হওয়া, ক্যাশ সার্ভার বন্ধ থাকা, মোবাইল ইন্টারনেট সেবা প্রদানকারী অপারেটরদের নতুন বিনিয়োগ না আসাসহ বেশকিছু কারণে মোবাইল ইন্টারনেট পরিষেবায় অগ্রগতি হচ্ছে না। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে বিটিআরসিকে আইনি সহযোগিতা দেয়ার পাশাপাশি সেলফোন অপারেটরদের বিনিয়োগ বৃদ্ধিতেও উৎসাহ দিতে হবে।

ওকলার স্পিডটেস্ট গ্লোবাল ইনডেক্সের তথ্য অনুযায়ী, দেশে মোবাইল ইন্টারনেটের বর্তমান ডাউনলোড স্পিড ২৮ দশমিক ৪২ এমবিপিএস, আপলোড স্পিড ১১ দশমিক ১৩ এমবিপিএস এবং ল্যাটেন্সি ২৫ এমএস (মিলি সেকেন্ড)। এর মধ্যে গত জুনে ডাউনলোড স্পিড ছিল ২৪ দশমিক ৪৯ এমবিপিএস, জুলাইয়ে তা ২৭ দশমিক ৮ এমবিপিএস, আগস্টে ২৭ দশমিক ৭৬ এমবিপিএস এবং সেপ্টেম্বরে ২৮ দশমিক ৪২ এমবিপিএস স্পিড ছিল।

ডাউনলোড স্পিড ঊর্ধ্বমুখী থাকলেও বিপরীত চিত্র দেখা যায় আপলোড স্পিডে। জুলাইয়ে ১১ দশমিক ৩১ এমবিপিএস, আগস্টে তা কমে ১১ দশমিক ২২ এমবিপিএস ও সেপ্টেম্বরে ১১ দশমিক ১৩ এমবিপিএসে দাঁড়ায়। ল্যাটেন্সিও কমেছে জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের মধ্যে। জুনে ল্যাটেন্সি ২৬ এমএস থাকলেও জুলাইয়ে তা কমে দাঁড়ায় ২৫ এমএসে। মূলত জুলাইয়ের ১৮ তারিখ থেকে মোবাইল ও ফিক্সড ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয় সরকার।

ল্যাটেন্সি বলতে ইন্টারনেটে ডাটা সরবরাহের সময়কে বোঝানো হয়। একজন গ্রাহকের পাঠানো ডাটা তার গন্তব্য পর্যন্ত যেতে যে সময়ের প্রয়োজন হয় তাকে ল্যাটেন্সি হিসেবে উল্লেখ করা হয়। প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডাটা সেন্টার ও ডিভাইসের মধ্যকার দূরত্ব, অতিরিক্ত ডাটা ট্রাফিক, বড় ফাইল ডাউনলোডের ক্ষেত্রে ল্যাটেন্সি বাড়তে থাকে। ডাটা ল্যাটেন্সিকে শূন্যে নামিয়ে আনার সুযোগ নেই। তবে অবকাঠামোগত উন্নয়নের মাধ্যমে ল্যাটেন্সি কমিয়ে আনার সুযোগ রয়েছে।

জানতে চাইলে রবি আজিয়াটা লিমিটেডের সাবেক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সিইও মাহতাব উদ্দিন চৌধুরী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘যে স্পিড ওকলা দেখাচ্ছে, তা একেবারে খারাপ না। এটা অনেক সময় জায়গার ওপর নির্ভর করে। অফিস বা বাসায় থাকলে স্পেকট্রাম সেভাবে পৌঁছতে পারে না। তার ওপর কাচের গ্লাস থাকলে নেটওয়ার্ক আরো বেশি বাধাগ্রস্ত হবে। এখানে শুধু একটা টেস্টের ওপর নির্ভর করে কিছু বলা যাবে না। সামগ্রিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে সিদ্ধান্তে আসা প্রয়োজন।’

রবি ও টেলিটক সিম ব্যবহার করেন একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা আজিজুর রহমান রিজভী। মোবাইল ইন্টারনেট ব্যবহারে নিজের অভিজ্ঞতা জানিয়ে বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘জুলাই ও জুলাই-পরবর্তী সময়ে ইন্টারনেট নেটওয়ার্ক, স্পিড, সেবার মানে ব্যাপক পতন ঘটে। বিশেষ করে রবি ও টেলিটকের ক্ষেত্রে ডাটা ব্যবহারের সময় হঠাৎই ফোরজি থেকে টুজি চলে আসা, এ জিনিসটা খুবই ঘন ঘন হচ্ছে। ঢাকার মতো এলাকায়ও এমন ঘটনা খুব বেশি ঘটছে। টেলিটকে ফোরজি/ থ্রিজি সিগন্যাল দেখালেও প্রায় সময় ডাটা ফাংশন করে না। হঠাৎ করেই ডাটা সিগন্যালও থাকে না। আর ডাউনলোড, আপলোড স্পিডের দশা তো করুণ!’

প্রযুক্তিবিদরা বলছেন, একসময় দেশে আইএসপি অপারেটর ও মোবাইল অপারেটরদের কাছে গুগল ও ফেসবুকের পয়েন্টস অব প্রেজেন্টস (পিওপি) ছিল। এসব পিওপি ডাটা সেন্টারের ক্যাশ সার্ভার হিসেবে কাজ করত। গ্রাহকরা যখন একটি তথ্য মূল ডাটা সেন্টার থেকে সংগ্রহ করত, তখন সেটি ক্যাশ সার্ভারে সংরক্ষিত থাকত। পরবর্তী সময়ে অন্য গ্রাহকরা সে তথ্য খুঁজতে চাইলে পার্শ্ববর্তী সিডিএন সার্ভার থেকে সংশ্লিষ্ট ওয়েবসাইটের তথ্য খুঁজে আনে সার্ভার।

সিডিএন সাধারণত তিনটি পদ্ধতিতে কাজ করে। কনটেন্টকে ভিজিটরের কাছাকাছি নিয়ে আসার জন্য এখানে পয়েন্ট অব প্রেজেন্স (পিওপি) ব্যবহার করা হয়। অর্থাৎ একসঙ্গে অনেকগুলো ক্যাশিং সার্ভার নিয়ে অনেকটা ডাটা সেন্টারের মতো তৈরি করা হয়। প্রতিটি ডাটা সেন্টার বিশ্বের বিভিন্ন দেশে স্থাপন করা হয়, এভাবে ফাইল আদান-প্রদানের পুরো রাস্তা কমিয়ে আনা হয়।

তারপর প্রতিটি ক্যাশিং সার্ভার সিডিএন ইউজ করে প্রতিটি ওয়েবসাইট ক্যাশ করে রাখে। বিভিন্ন দেশে সার্ভার থাকার কারণে যেকোনো লোকেশন থেকে ওয়েবসাইট ভিজিট করলে সেই লোকেশনের কাছাকাছি সার্ভার থেকে পেজ লোড হয়। এতে যেমন ওয়েবসাইট লোডিং স্পিড কমে তেমনি ব্যান্ডউইডথ অনেক কম খরচ হয়।

জানতে চাইলে লিংকথ্রি টেকনোলজিস লিমিটেডের প্রধান প্রযুক্তি কর্মকর্তা (সিটিও) রকিবুল হাসান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমাদের দেশের ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের বড় সংখ্যক গুগল ও ফেসবুকসহ কিছু বিশেষ পরিষেবা ব্যবহারকারী। এসব কোম্পানির পয়েন্ট অব প্রেজেন্স (পিওপি) দেশের ভেতরে আনা প্রয়োজন। এ সিডিএন নেটওয়ার্ক বাংলাদেশে আনার ক্ষেত্রে “ইন্টারমিডিয়ারি লায়াবিলিটি প্রটেকশন” নীতিমালার মতো কিছু আইনি বাধা রয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘ধরুন, মেটা বা গুগল বাংলাদেশে তাদের পপের ডাটা সেন্টার খুলল। কিন্তু সেখানে যদি সরকারের জন্য সমস্যা সৃষ্টি করে এমন কিছু কনটেন্ট থাকে যা আসলে ব্যবহারকারীরা পোস্ট করেছে, তখন কী হবে? সরকার কি সেই ডাটা সেন্টার বন্ধ করে দিতে পারবে? এসব বিষয়ের পাশাপাশি ইন্টারন্যাশনাল ইনফ্রাস্ট্রাকচারসহ দেশে ইনভেস্টমেন্ট পরিস্থিতি সহজ করে এসব প্রতিষ্ঠানকে পিওপিতে বিনিয়োগের জন্য আহ্বান করতে হবে। এতে কাস্টমার এক্সপেরিয়েন্স বৃদ্ধি এবং ইন্টারনেটের দাম অনেক কমে আসতে বাধ্য। তখন আরো দ্রুতগতির ইন্টারনেট সেবা পাওয়া যাবে।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *