দক্ষিণ এশিয়ায় উদ্যোক্তা সমাজে অনুকরণীয় ছিলেন রতন টাটা

২০২০ সালের সেপ্টেম্বর। কর্মীদের ২০১৯-২০ অর্থবছরের জন্য ২৩৫ কোটি ৫৪ লাখ রুপি বোনাসের ঘোষণা করে টাটা স্টিল। কভিডের প্রাদুর্ভাবে ধুঁকতে থাকা দেশটির শিল্প খাত তখন লকডাউন আর ছাঁটাইয়ে বিপর্যস্ত। এমন এক মুহূর্তে কর্মীদের প্রতি দায়বদ্ধতার ওই বহিঃপ্রকাশে সে সময় বেশ প্রশংসিত হয় টাটা গ্রুপ।

সে সময় বিষয়টিকে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে টাটা গ্রুপের ব্যবসার সামাজিক ভিত্তি সংরক্ষণের ঐতিহ্যের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে বর্ণনা করা হয়। ব্যবসা শিক্ষার পণ্ডিত ও পর্যবেক্ষকদেরও বিভিন্ন আলোচনায় উঠে এসেছে, এখন পর্যন্ত টাটা গ্রুপের সবচেয়ে বড় শক্তি হলো প্রতিষ্ঠানটির ব্যবসার সামাজিক ভিত্তি। সদ্যপ্রয়াত রতন টাটার অধীনে উপমহাদেশের বৃহৎ এ কনগ্লোমারেটটির সেই ভিত্তি আরো শক্তিশালী হয়ে ওঠে। ভারতীয় থেকে বৈশ্বিক জায়ান্টে রূপ নেয় টাটা গ্রুপ। আর রতন নাভাল টাটা নিজেও হয়ে ওঠেন দক্ষিণ এশিয়ায় উদ্যোক্তা সমাজে অনুকরণীয় এক ব্যক্তিত্ব।

রতন টাটার প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে ভারত, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশের উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিপুল পরিমাণ অর্থ অনুদান দিয়েছে টাটা ট্রাস্ট। ২০১৬ সালে ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া স্যান ডিয়েগোয় টাটা ইনস্টিটিউট ফর জেনেটিক্স অ্যান্ড সোসাইটি (টিআইজিএস) প্রতিষ্ঠায় ৭০ মিলিয়ন ডলার অনুদান দেয় টাটা গ্রুপ। বর্তমানে সেখানে জিন এডিটিং, স্টেম সেল থেরাপি ও রোগ নিয়ন্ত্রণের মতো বিষয়াদি নিয়ে গবেষণা হচ্ছে। নিউইয়র্কের কর্নেল ইউনিভার্সিটি টাটা গ্রুপের পক্ষ থেকে ২৮ মিলিয়ন ডলারের একটি স্কলারশিপ ফান্ড গড়ে তোলা হয়েছে, যার মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে প্রতি বছর ভারতীয় ২০ মেধাবী শিক্ষার্থীকে সহায়তা করা হচ্ছে।

হার্ভার্ড বিজনেস স্কুলে একটি এক্সিকিউটিভ সেন্টার গড়ে তুলতে ২০১০ সালে টাটা গ্রুপের কোম্পানিগুলো এবং টাটা চ্যারিটির পক্ষ থেকে ৫০ মিলিয়ন ডলার অনুদান দেয়া হয়। পেনসিলভানিয়ায় কার্নেগি মেলন ইউনিভার্সিটিতে একটি কগনিটিভ সিস্টেম ও স্বচালিত যান নিয়ে গবেষণার জন্য একটি ভবন তৈরিতে ৩৫ মিলিয়ন ডলার অনুদান দিয়েছে টাটা কনসালট্যান্সি সার্ভিসেস।

মুম্বাইয়ের ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে অনুদানের মাধ্যমে টাটা সেন্টার ফর টেকনোলজি অ্যান্ড ডিজাইন গড়ে তুলতে ২০১৪ সালে ৯৫ কোটি রুপি অনুদান দেয় টাটা গ্রুপ। রতন টাটা চেয়ারম্যান থাকাকালে টাটা ট্রাস্ট থেকে আলঝেইমার নিয়ে গবেষণার জন্য ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্সের সেন্টার ফর নিউরোসায়েন্সকে অনুদান দেয়া হয়েছে ৭৫ কোটি রুপি। সম্পদের দিক থেকে পিছিয়ে থাকা বিভিন্ন গোষ্ঠীর নানা চ্যালেঞ্জ নিয়ে গবেষণার জন্য ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে (এমআইটি) গড়ে তোলা হয়েছে এমআইটি টাটা সেন্টার অব টেকনোলজি অ্যান্ড ডিজাইন। মূলত ভারতীয় জনগোষ্ঠীগুলোকে কেন্দ্র করে সেন্টারটি নির্মাণ করেছে টাটা গ্রুপ। এটিও গড়ে তোলা হয়েছে রতন টাটার তত্ত্বাবধানে।

রতন টাটা পড়াশোনা করেছিলেন স্থাপত্য বিদ্যায়। যদিও স্থপতি হিসেবে স্বাধীন চর্চার পরিবর্তে পারিবারিক ব্যবসার সঙ্গেই যুক্ত হয়েছিলেন তিনি। টাটা গ্রুপের সঙ্গে তিনি যুক্ত ছিলেন ১৯৬২ সাল থেকে। তবে ১৯৯১ সালে পরবর্তী কর্ণধার হিসেবে তার নাম ঘোষণা করে টাটা গ্রুপের চেয়ারম্যানের পদ থেকে সরে দাঁড়ান জেআরডি টাটা। সে সময় অনেকেই রতন টাটা ভারতের বনেদি কনগ্লোমারেটটির ব্যবসায়িক ঐতিহ্য ধরে রাখতে সমর্থ হবেন কিনা, সে বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন।

যদিও তার অধীনে টাটাদের ব্যবসায়িক সাম্রাজ্যের বিস্তার ঘটেছে ব্যাপক মাত্রায়। গ্রুপটির ব্যবসা বিস্তৃত হয়েছে স্টিল থেকে সফটওয়্যার পর্যন্ত। বর্তমানে টাটা গ্রুপের ১০০টিরও বেশি কোম্পানিতে কর্মসংস্থান হয়েছে ৬ লাখ ৬০ হাজার মানুষের। ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান হিসেবে টাটার বার্ষিক রাজস্ব এখন ১ হাজার কোটি ডলারেরও বেশি।

একই সঙ্গে পরিবারের ঐতিহ্যকে ধরে রেখে গ্রুপের সামাজিক কার্যক্রমগুলোকেও আরো শক্তিশালী করেন তিনি। ভারতীয় গবেষণা প্রতিষ্ঠান হুরুন রিসার্চ ও এডেলগিভ ফাউন্ডেশনের হিসাব অনুযায়ী, গত শতকে বিশ্বব্যাপী দাতা প্রতিষ্ঠান হিসেবে শীর্ষে ছিল টাটা গ্রুপ। এ সময় বিশ্বব্যাপী প্রতিষ্ঠানটির বিভিন্ন জনকল্যাণমূলক কাজে ব্যয়ের পরিমাণ ছিল ৮৩ হাজার ২০০ কোটি ডলারের সমপরিমাণ।

চলতি শতকেও রতন টাটার অধীনে এসব কার্যক্রম অব্যাহত রাখে টাটা গ্রুপ। বিশেষ করে বিভিন্ন শিক্ষামূলক ও গবেষণা কার্যক্রমে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করে প্রতিষ্ঠানটি। এগুলোর মধ্য দিয়ে বিশ্বব্যাপী টাটা গ্রুপের ব্যবসায়িক এবং সামাজিক ভিত্তি হয়ে ওঠে আরো শক্তিশালী ও বিস্তৃত।

যদিও টাটা গ্রুপের দায়িত্ব গ্রহণের সময় গ্রুপটির বিভিন্ন সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠানের প্রধানদের কাছ থেকে ব্যাপক বিরোধিতার সম্মুখীন হতে হয় রতন টাটাকে। পরে এ বিরোধিতার মাত্রা বেড়ে গেলে বেশকিছু সংস্কারমূলক পদক্ষেপ নেন রতন টাটা। বয়সভিত্তিক অবসর পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পাশাপাশি সাবসিডিয়ারিগুলোর ওপর শক্তিশালী নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। একই সঙ্গে টাটা গ্রুপের সাবসিডিয়ারিগুলোর মুনাফার একাংশ টাটা গ্রুপের ব্র্যান্ডভিত্তি সম্প্রসারণে বিনিয়োগের নিয়মও চালু করেন। জোর দেন উদ্ভাবন ও তরুণ নেতৃত্ব গঠনে। ভারতীয় প্রতিষ্ঠান থেকে বৈশ্বিক জায়ান্টে রূপ নেয় টাটা গ্রুপ।

রতন টাটা গ্রুপের চেয়ারম্যান হিসেবে প্রথম দফায় দায়িত্ব পালন করেন ১৯৯১ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের এক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, এ সময়ের মধ্যে টাটা গ্রুপের রাজস্ব বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪০ গুণেরও বেশিতে। একই সঙ্গে মুনাফার আকার বেড়েছে ৫০ গুণেরও বেশি। তিনি যখন দায়িত্ব নেন, তখন টাটা গ্রুপের মোট বিক্রির বড় অংশ জুড়ে ছিল কমোডিটি ট্রেডিং। তার অধীনে গ্রুপটির আয়ের উৎস হয়ে ওঠে বিভিন্ন ব্র্যান্ড। টাটা গ্রুপের বড় তিনটি অধিগ্রহণ সরাসরি তত্ত্বাবধান করেন তিনি। টাটা টি কোম্পানি ইয়র্কশায়ারভিত্তিক বেভারেজ কোম্পানি টেটলিকে অধিগ্রহণ করে ২০০০ সালে। টাটা মোটরস ফোর্ড মোটর কোম্পানির কাছ থেকে জাগুয়ার ও ল্যান্ড রোভারকে অধিগ্রহণ করে জাগুয়ার ল্যান্ড রোভার প্রতিষ্ঠা করে ২০০৮ সালে। টাটা স্টিল ব্রিটিশ-ডাচ কোম্পানি কোরাসকে অধিগ্রহণ করে ২০০৭ সালে। এসব অধিগ্রহণের মধ্য দিয়ে ভারতভিত্তিক থেকে বৈশ্বিক ব্যবসায়িক কনগ্লোমারেটে রূপ নেয় টাটা গ্রুপ। প্রতিষ্ঠানটির মোট আয়ের ৬৫ শতাংশেরই উৎস হয়ে ওঠে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ব্যবসায়িক কার্যক্রম।

বাংলাদেশে ব্যবসা সম্প্রসারণ নিয়েও বড় পরিকল্পনা ছিল টাটা গ্রুপের। এখন পর্যন্ত দেশে দেশে ভারী মৌলিক শিল্পের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বিদেশী বিনিয়োগের প্রস্তাবটি এসেছে টাটা গ্রুপের কাছ থেকেই। ২০০৪ সালে প্রথম দেশে সার, ইস্পাত ও বিদ্যুৎ খাতে মোট ২০০ কোটি ডলার বিনিয়োগের আগ্রহ প্রকাশ করে গ্রুপটি। ওই বছরের অক্টোবরে এ নিয়ে প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে সরকারের প্রাথমিক একটি সমঝোতাও হয়েছিল। সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচনার পর সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের ভিত্তিতে ২০০৬ সালের এপ্রিলে প্রস্তাবিত বিনিয়োগের পরিমাণ তোলা হয় ৩০০ কোটি ডলারে। সে সময় বাংলাদেশে কার্যক্রম চালাতে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহের নিশ্চয়তা চেয়েছিল টাটা গ্রুপ। কিন্তু জ্বালানি সংকটের কারণে টাটার প্রস্তাব নিয়ে দীর্ঘদিন সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগেছে বাংলাদেশ। এক পর্যায়ে কনগ্লোমারেটটি এ প্রস্তাব প্রত্যাহার করে নেয়। এর পর থেকে আজ পর্যন্ত দেশের ভারী মৌলিক শিল্প খাতে বিদেশী বিনিয়োগের আর কোনো বড় প্রস্তাব পায়নি বাংলাদেশ। টাটার বিনিয়োগ প্রস্তাবটি বাস্তবায়ন হলে দেশের বিনিয়োগ পরিবেশ অনেকটাই অন্যরকম হতে পারত বলে ধারণা খাতসংশ্লিষ্টদের।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *