অন্তর্বর্তী সরকারকে ব্যর্থ করতে স্বৈরাচারের দোসরদের ষড়যন্ত্র থেমে নেই মন্তব্য করে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, প্রতিটি নেতাকর্মীর মধ্যে বিজয়ের আত্মবিশ্বাস থাকা ভালো, তবে অতি আত্মবিশ্বাসী হয়ে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হবেন না। জনগণ পছন্দ করে না এমন কাজ থেকে নিজেকে বিরত রাখুন। জনগণের বিশ্বাস ও ভালোবাসা অর্জন করুন। গতকাল বুধবার বিকেলে রাজধানীর রমনায় ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে ‘৭ নভেম্বর জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস’ উপলক্ষে আলোচনা সভায় তিনি এসব কথা বলেন।
সভার শুরুতে পবিত্র কুরআন তিলাওয়াত করা হয়। সভায় জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবসের ডকুমেন্টারি দেখানো হয়। ৭ নভেম্বর উপলক্ষে সভায় বিএনপির পক্ষ থেকে এটি প্রকাশ করা হয়।
তারেক রহমান বলেন, দেশকে একটি ভঙ্গুর রাষ্ট্রে পরিণত করে মাফিয়া সরকারের প্রধান দেশ ছেড়ে পালিয়েছে। স্বৈরাচারের ১৫ বছরের দুঃশাসনের কুফল এখনো জনগণকে বয়ে বেড়াতে হচ্ছে। এমন বিভীষিকাময় পরিস্থিতিতে ছাত্র-জনতার রক্তক্ষয়ী গণ-অভ্যুত্থানে হাজারো শহীদের রক্তস্নাত বাংলাদেশে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পলাতক স্বৈরাচারের পরাজয় হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে আরো একবার প্রমাণিত হয়েছে, দেশ ও জনগণের স্বাধীনতা রক্ষা করতে হলে জাতীয়তাবাদী শক্তির বৃহৎ ঐক্যের কোনো বিকল্প নেই।
তিনি বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মেয়াদ তিন মাস পূর্ণ হতে যাচ্ছে। একটি সরকারের সাফল্য কিংবা ব্যর্থতা মূল্যায়নের জন্য তিন মাস যথেষ্ট সময় নয়; কিন্তু মনে রাখা দরকার বাজারে দ্রব্যমূল্যের সাথে যুদ্ধ করতে গিয়ে প্রতিদিন জনগণকে হার মানতে হয়। তিন মাস সময় তাদের (জনগণ) কাছে মনে হতে পারে তিন বছরের সমান। বিশেষ করে কৃষক, শ্রমিক, দিনমজুর ও স্বল্প আয়ের মানুষের প্রতিদিনের দুঃখ-দুর্দশা লাঘব করতে কঠোর হাতে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা অতন্ত্য জরুরি।
তিনি বলেন, রাষ্ট্র মেরামত তথা প্রচলিত বিধিবিধান সংস্কারের জন্য সরকার কাজ শুরু করেছে। বিএনপি সংস্কারের পক্ষে, তবে রাষ্ট্র্র কিংবা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের প্রথাগত সংস্কারের চেয়ে জনগণের রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে রাজনীতি, রাজনৈতিক দল ও কর্মী-সমর্থকদের গুণগত পরিবর্তন সংস্কার বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনায় শেষ পর্যন্ত রাজনীতিকদের দ্বারাই রাষ্ট্র পরিচালিত হয়। গত ১৫ বছর জনগণের ভোট ছাড়াই তথাকথিত জনপ্রতিনিধিকে নির্বাচিত ঘোষণা করা হয়েছে। দেশের সর্বোচ্চ আদালতকে প্রকাশ্যে ফ্যাসিবাদের পক্ষ অবলম্বন করতে দেখা গেছে। এ জন্য জনগণের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন প্রয়োজন।
তারেক রহমান বলেন, নির্বাচন কমিশনের সংস্কার কার্যক্রমের পাশাপাশি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ইতোমধ্যে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন কার্যক্রম শুরু করেছে। জনগণের রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন তথা জনগণের লুণ্ঠিত ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠার দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামের যাত্রাপথের এটি একটি শুরু মাত্র। সংস্কার কার্যক্রম এবং নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনের ধারাবাহিকতায় যথানিয়মে নির্বাচনী কার্যক্রম শুরু হবে।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ৭ নভেম্বর শুধু একটি দিন নয়, দিবস নয়; ৭ নভেম্বর দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করেছিল। নতুন সত্তা পেয়েছিল। নতুন ইতিহাসের সূচনা হয়েছিল। সেই ইতিহাসের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। ২৪-এর ৫ আগস্ট আরেকটি বিপ্লব ও অভ্যুত্থান ঘটেছে। পরাজিত করা হয়েছে ফ্যাসিস্ট হাসিনাকে (শেখ হাসিনা)। ফ্যাসিবাদের কবল থেকে মুক্ত হয়েছি। এখন ভবিষ্যতে সতর্কতার সাথে পার হতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকার অতি অল্প সময়ে মধ্যে প্রয়োজনীর সংস্কার শেষে নির্বাচনের পরিবেশের তৈরি করবে। জনগণের শাসন প্রতিষ্ঠিত করতে তারা সাহায্য করবে।
তিনি বলেন, অর্থনীতির অবকাঠামো তৈরি, উন্নয়নের ভিত্তি, বৈদেশিক বাজার তৈরি করেছিলেন জিয়াউর রহমান। ৯০-এ ছাত্র-জনতা আরেকটি অভ্যুত্থানে বেগম খালেদা জিয়াকে ক্ষমতায় নিয়ে এসেছিল। ২৪-এ আরেকটি ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে আবার মুক্ত দেশ পেয়েছি।
নির্বাচন ইস্যুতে মির্জা ফখরুল বলেন, ড. ইউনূসের সরকারকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে প্রয়োজনীয় সংস্কার করতে। তিনি অতিদ্রুত সেই সংস্কারগুলো করে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন দেবেন এবং জনগণের শাসন প্রতিষ্ঠা করবেন বলে প্রত্যাশা করি।
স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, গত ১৬ বছর ৭ নভেম্বর অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে আমরা পালন করতে পারিনি। এই দিবস জাতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আর ৫ আগস্ট বিপ্লব হয়নি। এটা ধারাবাহিকতা হয়েছে। বিপ্লব হয়েছে ৭ নভেম্বর। এটা (৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার) হয়েছে অভ্যুত্থান। সুতরাং দ্রুত নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা দিতে হবে। অন্যথায় আমরা রাজপথে ছিলাম, আছি। আমরা মাঠ ছাড়ি নাই।
স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেন, এটা বিএনপির কোনো দিবস (৭ নভেম্বর) না। এই দিবসটি দেশের জনগণের দিবস। জনগণ শ্রদ্ধার সাথে এ দিবসটি পালন করত। আজকের এই দিবসকে স্বীকৃত দিয়ে বর্তমান সরকার কিংবা যে সরকার আসবে তারা যথাযথভাবে পালন করবে।
স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দানব উপস্থিত হয়েছিল। নতুন বাংলাদেশ গড়ার জন্য বেগম খালেদা জিয়া আবার আন্দোলনে নেমেছিলেন। শেষ পর্যন্ত আন্দোলন থেকে সরে দাঁড়াননি। সেই হাল ধরেছেন তারেক রহমান। হাসিনা চলে গেছেন। সেই লড়াই এখনো চলছে। আজকে আবার সেই গণতন্ত্র পুনঃপ্রবর্তনের সম্মুখীন হয়েছি।
স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, শক্তিশালী সমাজ বিনির্মাণের জন্য অর্ন্তবর্তী সরকার সংস্কারের কথা বলছে। সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া। যতদিন বাংলাদেশ থাকবে ততদিন সংস্কারের মধ্যে দিয়ে যাবে। সেই সংস্কারকে যদি একমাত্র কর্তব্য বর্তমান সরকারের কাছে হয় তাহলে ভুল হবে। জনগণের ভোটে নির্বাচিত রাজনৈতিক দলই সেটি পারে। যদি ভাবেন সব সংস্কার শেষে নির্বাচন দিবেন তাহলে তো আপনাদের রোজ কেয়ামত পর্যন্ত আপনাদের থাকতে হবে। আর নির্বাচন ও সংস্কারের কাজ একসাথে চলতে তো বাধা নাই।
স্থায়ী কমিটির মেজর (অব:) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ বলেন, আমরা নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছি। সরকার চাইলে মার্চ-এপ্রিলের মধ্যে নির্বাচন দিতে পারে; কিন্তু অত্যন্ত পরিত্রাপের বিষয় সরকার এখনো নির্বাচনের রোডম্যাপ দেয়নি। নির্বাচন কমিশন গঠন করেনি। নির্বাচিত সরকারই পারে সংবিধান সংশোধন করতে।
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সভাপতিত্বে এবং বিএনপির প্রচার সম্পাদক সুলতান সালাউদ্দিন টুকুর সঞ্চালনায় সভায় আরো বক্তব্যে রাখেন- অর্থনীতিবিদ ড. মাহবুব উল্লাহ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কামরুল আহসান, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, ডা: এ জেড এম জাহিদ হোসেন, ভাইস চেয়ারম্যান আহমেদ আযম খান, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আবদুস সালাম, খালেদা জিয়ার বিশেষ সহকারী অ্যাডভোকেট শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির আহ্বায়ক রফিকুল আলম মজনু, উত্তরের আহ্বায়ক আমিনুল হক, যুবদলের সভাপতি আব্দুল মোনায়েম মুন্না, স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি এস এম জিলানী, কৃষকদলের সভাপতি হাসান জাফির তুহিন, ছাত্রদলের সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রাকিব প্রমুখ। এ ছাড়া সভায় বিএনপি এবং এর অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা উপস্থিত ছিলেন।