প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হতে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রে। কিন্তু আলোচনা চলছে সারা বিশ্বে। বাংলাদেশও ব্যতিক্রম নয়। দেশের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক মহলের দৃষ্টি এখন মার্কিন নির্বাচনের দিকে। ভোটে ডোনাল্ড ট্রাম্প নাকি কমলা হ্যারিস জিতবেন তা নিয়েই আগ্রহ সবার। কারণ হিসেবে বিশ্লেষকরা বলছেন, ট্রাম্প ও কমলা দুজনই দুই ধরনের দর্শনের ব্যক্তিত্ব এবং রাজনীতিক। যিনি জিতবেন তাঁর ইচ্ছা-অনিচ্ছার প্রভাব যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিতে স্পষ্টভাবেই পড়বে। এতে পুরো বিশ্বের চলমান বড় ইস্যুগুলোর মতো বাংলাদেশেরও অভিবাসন, শরণার্থী সহায়তা, অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক সম্পর্কে প্রভাব পড়বে। এসব কারণে ভোট যুক্তরাষ্ট্রে হলেও নানা সমীকরণ নিয়ে আলোচনা চলছে ঢাকায়। কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানান, আর মাত্র তিন দিন পরই যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন। আমেরিকানরা তাদের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী ও বর্তমান ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস নাকি রিপাবলিকান প্রার্থী ও সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে বেছে নেন তা দেখার অপেক্ষায় বিশ্ববাসী। ইসরায়েল-ফিলিস্তিন যুদ্ধ, ইরান সংকট, ইউক্রেন যুদ্ধের মতো বড় বিষয়গুলোই ছিল আলোচনায়। কিন্তু সর্বশেষ দীপাবলি উপলক্ষে ডোনাল্ড ট্রাম্পের একটি টুইট বাংলাদেশে আলোচনায় নতুন মাত্রা তৈরি করেছে। টুইটে বাংলাদেশের হিন্দুসহ সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের নিন্দা জানিয়ে বক্তব্য দিয়ে বলেছেন, ‘আমি থাকলে এমন পরিস্থিতি হতো না।’ এরপর নানা মহল থেকে বলা হচ্ছে, ট্রাম্প জিতলে ভারতের নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ও বাংলাদেশের বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে মার্কিনিদের অতি ঘনিষ্ঠতায় ঘাটতি দেখা দিতে পারে। ফলে রাজনৈতিক ও গণমানুষের আলোচনায় চলছে নানা হিসাবনিকাশ। যদিও কূটনৈতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ট্রাম্পের টুইট পুরোপুরিই নির্বাচনি একটি কৌশল। যুক্তরাষ্ট্রে থাকা বিশালসংখ্যক হিন্দু ভোটারকে আকৃষ্ট করতেই ট্রাম্প এ অবস্থান নিয়েছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক অধ্যাপক এম শাহীদুজ্জামান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমেরিকাতে যখনই নির্বাচন হয় সারা বিশ্বে তার প্রভাব পড়ে। এবারও দুই প্রার্থীই সমানে সমান। সর্বশেষ শোনা যাচ্ছে, ট্রাম্প নাকি খুব ভালোভাবে এগিয়ে আছেন। পেনসিলভানিয়াতে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে। আর দুই-তিন দিনের মধ্যে পুরো পরিস্থিতিটা পরিষ্কার হবে। ইতোমধ্যে ৬ কোটি মানুষ ভোট দিয়েছেন। প্রাপ্ত ভোট থেকে বোঝা যাচ্ছে ২০২০ সালের তুলনায় ডোনাল্ড ট্রাম্প ভালো করছেন। তিনি বলেন, মার্কিন নির্বাচন বাংলাদেশের ওপর খুব তাৎপর্যপূর্ণ প্রভাব ফেলবে না। আমাদের হিন্দুদের বিষয় নিয়ে ট্রাম্প যা বলছেন তা সম্পূর্ণভাবে নির্বাচনি প্রপাগান্ডার অংশ। এর কোনো বাস্তবিক প্রয়োগ নেই। তাই ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় এলে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর এর কোনো বিরূপ প্রভাব পড়বে না। আমাদের শুধু ভালো কূটনীতিকের প্রয়োজন পড়বে, যারা ডোনাল্ড ট্রাম্পের নিযুক্ত কূটনীতিককে যথাযথভাবে আমাদের দেশের প্রকৃত পরিস্থিতি বোঝাতে পারবেন। আর নরেন্দ্র মোদি ব্যক্তিগতভাবে ট্রাম্পকে বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের বিষয়ে যেসব অভিযোগ করেছেন তা খুব বেশি প্রভাব ফেলবে না। কারণ ভারতে নরেন্দ্র মোদির মানবাধিকারের অবস্থা খুবই খারাপ, ট্রাম্পও এটা জানেন। ট্রাম্প মোদির কথায় খুব বেশি গুরুত্ব দিতে গিয়ে নিজের জনপ্রিয়তা হারাতে চাইবেন না। মূলত আওয়ামী লীগ নিজেদের গা বাঁচানোর জন্য এ ধরনের অপপ্রচার চালাচ্ছে। তিনি বলেন, আমেরিকাতে ভারতের প্রচুর হিন্দু ভোটার। ট্রাম্প মূলত তাদের ভোট টানার জন্য এ ধরনের কথাবার্তা বলছেন। যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ূন কবির বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে ট্রাম্প টুইট করেছেন। এটা নিয়ে অনেক আলোচনা। তবে আমার মনে হয় না, নীতিগতভাবে বাংলাদেশের চলমান সংস্কার কার্যক্রমে ট্রাম্প প্রশাসন কোনো প্রভাব ফেলবে। বরং সেগুলো তিনি অব্যাহত রাখবেন। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া শক্তিশালী করতে ট্রাম্প কিংবা হ্যারিস যে কোনো প্রশাসনই সহযোগিতা করবে। তিনি বলেন, এ সংস্কার প্রক্রিয়া সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করে যদি বাংলাদেশকে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত করা যায় এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে যদি আমরা গণতন্ত্র পরিচালনা করতে পারি তাহলে আমাদের অর্থনীতির ওপর ইতিবাচক প্রভাব আসবে। বিশ্বদরবারে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি বাড়বে। আমাদের নিজস্ব শক্তিও বিশ্বমন্ডলে উপস্থাপিত হবে। হুমায়ূন কবিরের মতে, অন্যান্য ইস্যুতে বাংলাদেশের চিন্তার বিষয় থাকতে পারে। যেমন ট্রাম্প নির্বাচনে জিতলে অনিয়মিত অভিবাসীদের বের করে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি এক্ষেত্রে কতটুকু সফল হবেন তা বলা যাচ্ছে না। তবে এ ব্যাপারে তাঁর উদ্যোগ গ্রহণের সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের অনেক দক্ষ মানুষ আমেরিকায় আছেন। গত মেয়াদে ক্ষমতা থাকাকালে তিনি এ বিশেষ ভিসায় কড়াকড়ি আরোপ করেছিলেন। এতে ভারতীয়রা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। এবার তিনি এ ভিসায় আরও কড়াকড়ি আরোপ করতে পারেন বলে আশঙ্কা করছি। এ ছাড়াও তিনি ইমিগ্রেশনের বিষয়ে বেশি মনোযোগী হবেন। তাতে করে বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর জনগোষ্ঠী ক্ষতির মুখে পড়বে। সর্বশেষ বর্ণবাদী চিন্তাধারা বিস্তারের একটা আশঙ্কা রয়েছে। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ থেকে যে বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী পড়াশোনা করতে আমেরিকা যায় সেটার ওপর প্রভাব পড়বে। কারণ এখন পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের পছন্দের তালিকার শীর্ষে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। সেই জায়গায় যদি তরুণরা যেতে না পারে বা যাওয়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলে তাহলে উচ্চশিক্ষায় আমরা ঘাটতিতে পড়তে পারি।
বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে ট্রাম্প ও কমলার জয়-পরাজয় বড় ধরনের প্রভাব বিস্তার করতে পারে মন্তব্য করে হুমায়ূন কবির বলেন, ডোনাল্ড ট্রাম্প ও কমলা হ্যারিসের রাজনৈতিক দর্শন ভিন্ন এবং তাঁদের পররাষ্ট্রনীতিও ভিন্ন। ফলে যিনি নির্বাচনে জয়লাভ করবেন তাঁর পররাষ্ট্রনীতিই বৈশ্বিকভাবে প্রভাব ফেলবে। বাইডেন প্রশাসন যেই নীতিতে চলেছে কমলা হ্যারিস মোটামুটি একই নীতি অনুসরণ করবেন। বিশেষ করে মিত্রদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রাখা। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে ইউক্রেনকে সমর্থন অব্যাহত রাখবেন। মধ্যপ্রাচ্য সংকটে ইসরায়েল ইস্যুতে বাইডেন প্রশাসনের চেয়ে তিনি কিছুটা কঠোর হবেন। ফিলিস্তিনিদের কথা হয়তো তিনি বলবেন। তবে বাস্তব অর্থে সেটা কতটা কার্যকর হবে তা বলা মুশকিল। ইরানের সঙ্গেও হয়তো তিনি বাইডেন প্রশাসনের নীতিই অনুসরণ করতে পারেন। অথবা পারমাণবিক চুক্তি পুনরায় চালু করতে পারেন। এখনকার পরিস্থিতিতে এটা না হলে ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির দিকে আগাতে পারে। এটাকে প্রতিরোধ করতে হলে ইরানের সঙ্গে পারমাণবিক চুক্তি পুনরুজ্জীবিত করা ছাড়া ভালো বিকল্প আছে বলে মনে হয় না। আর আন্তর্জাতিক অর্থনীতির ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যেসব অর্থনৈতিক সাহায্য করে থাকে তা কমলা হ্যারিস প্রশাসন হয়তো চালু রাখবে। এক্ষেত্রে আমাদের মতো ছোট দেশগুলোয় আর্থিক সহায়তা অব্যাহত থাকতে পারে। অন্যদিকে ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচনে জয়লাভ করলে বর্তমান নীতিতে অনেক পরিবর্তন আসবে। এর আগে যখন ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন সেবারও তিনি ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতি অনুসরণ করেছেন। এবারও হয়তো তিনি সেটাই করবেন। এর ফলে ইউক্রেন যুদ্ধে বর্তমান মার্কিন নীতিমালার পরিবর্তন আসতে পারে। তবে সেই পরিবর্তনের চেহারা কী হবে তা এ মুহূর্তে বলা মুশকিল। যদিও ট্রাম্প বলেন, ‘আমি যুদ্ধ থামিয়ে ফেলব। পুতিন আমার কথা শুনবেন।’ তবে বাস্তব অর্থে এ বিষয়টা অনেক জটিল। এদিকে মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে তিনি ফ্রি হ্যান্ড করে দেবেন। এখন গাজায় ইসরায়েলিরা যে হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে তা হয়তো অব্যাহত থাকবে। ইসরায়েল গাজা দখল করতে চাইলে সেটাতেও ট্রাম্প সায় দিতে পারেন। ইসরায়েল যদি ইরানের বিরুদ্ধে হামলা চালাতে চায় তাহলে বাইডেন প্রশাসনের মতো তিনি হয়তো বাধা দেবেন না। গত আমলে ট্রাম্প যা করেছেন সেটাকেই হয়তো এবারও এগিয়ে নিতে চাইবেন। তাতে করে ফিলিস্তিনিদের স্বার্থ আরও ক্ষুণ হবে। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মানবিক সাহায্য-সহযোগিতায়ও কিছুটা পরিবর্তন আসতে পারে। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের মতো অর্থনীতির দেশগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হবে।