সিঁদুর খেলায় শেষ হলো ‘বাইশ পুতুল’খ্যাত বারঘরিয়ার ঐতিহ্যবাহী দুর্গাপূজা

ঢাকের তালে নাচ আর সন্ধ্যায় সিঁদুর খেলার মধ্য দিয়ে শেষ হলো চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার মধ্যে সবচেয়ে বড় ও বহু পুরোনো বারঘরিয়ার ঐতিহ্যবাহী দুর্গাপূজার আনুষ্ঠানিকতা। রাতে মহানন্দা নদীতে দেওয়া হবে বিসর্জন। এ পূজা উদ্‌যাপনের এবার ৩১৫তম বার্ষিকী বলে দাবি পূজা উদ্‌যাপন কমিটির। তাদের ব্যানারেও লেখা আছে সে কথা।

‘বাইশ পুতুল’খ্যাত এ পূজায় দূরদূরান্ত থেকে শত শত পুণ্যার্থী আসেন। এর সামনে রাস্তার পাশে বসে মেলা। বাইশ পুতুলের প্রতিমা দর্শন না করলে, মেলায় না ঘুরলে জেলার ও জেলার বাইরের হাজারো মানুষের দুর্গোৎসবই জমে না। বাইশ পুতুলের দুর্গাপূজা নিয়ে এমন কথা অনেক আগে থেকেই চলে আসছে।

আয়োজকদের সূত্রে জানা গেছে, বাইশ পুতুল, অর্থাৎ বাইশ মূর্তির মধ্যে সবার ওপরে রয়েছে গঙ্গা দেবী। এর নিচে গাড়ির ওপর গলায় সাপ প্যাঁচানো মহাদেব, তাঁর দুই পাশে দূত নন্দি ও বন্দি, রাম ও লক্ষ্মণ। এরপর মধ্যে দেবী দুর্গা। আছে কার্তিক, গণেশ, লক্ষ্মী, সরস্বতী—তাঁদের বাহন ইঁদুর, ময়ূর, প্যাঁচা ও সাদা হাঁস। সব মিলিয়ে বাইশ প্রতিমা। এ থেকেই বাইশ পুতুলের দুর্গাপূজা হিসেবে খ্যাতি। অন্যান্য পূজায় কোথাও বাইশটি প্রতিমার পূজা দেখা যায় না।

তবে ঠিক কার বা কাদের হাত ধরে এ পূজার শুরু, কেউ তা বলতে পারে না। তবে ১৯৮৭ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত পূজা উদ্‌যাপন কমিটির কোষাধ্যক্ষ পদে থাকা বাসুদেব চন্দ্রপাল (৫৮) ও এলাকার বয়স্ক ব্যক্তি প্রভাস কুমার সাহা প্রথম আলোকে জানান, জনশ্রুতি রয়েছে, ৩০০ বছরের বেশি সময় আগে বাইশ পুতুলের দুর্গাপূজা হতো গোমস্তাপুর উপজেলার চৌডালা ইউপির শুক্রবাড়ি গ্রামে। কোনো সমস্যার কারণে সেখানকার পূজা উদ্‌যাপনকারীরা পূজার পাঠ, অর্থাৎ কাঠের কাঠামো মহানন্দা নদীতে ভাসিয়ে দেন। ভাসতে ভাসতে ২৫-৩০ কিলোমিটার দূরে তা এসে ঠেকে সদর উপজেলার বারঘরিয়ার সামনে।

শুক্রবাড়ির পূজা উদ্‌যাপনকারীদের একজন স্বপ্নে নির্দেশিত হন—পূজার পাঠ যেখানে ঠেকেছে, সেখানের গ্রামে গিয়ে বাইশ পুতুলের এ পূজা প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। সে অনুযায়ী শুক্রবাড়ির লোকেরা বারঘরিয়া গ্রামে এসে এখানের হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতৃস্থানীয় লোকজনকে অনুরোধ জানান এ পূজা আয়োজনের জন্য। মন্দিরের জন্য কিনে দেন জমি। সেই থেকে বারঘরিয়ায় হয়ে আসছে প্রাচীন এই বাইশ পুতুলের দুর্গাপূজা।

গত শনি ও আজ রোববার পূজামণ্ডপ ও মেলা ঘুরে মানুষজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, জেলার মধ্যে সবচেয়ে জাঁকজমকপূর্ণ পূজায় এবার সেই আগের উচ্ছ্বাসটা টের পাওয়া যায়নি। গত শনিবার সন্ধ্যা সাতটা থেকে সাড়ে সাতটা পর্যন্ত দেখা যায়, ভিড় খুব একটা ছিল না। কমিটির সাধারণ সম্পাদক মৃণাল কান্তি পাল প্রথম আলোকে বলেন, নবমীর দিনে সব সময় থাকে উপচে পড়া ভিড়। মানুষজনকে এ সময় মণ্ডপে আসতে-যেতে অনেক কসরত করতে হয়। অন্যান্যবারের তুলনায় এবার মণ্ডপে পূজার দানবাক্সে দানও পড়েছে অনেক কম। অথচ খরচ এবার অনেক বেশি। কয়েক দিন ধরে প্রতি রাতে পাহারা দেওয়ার জন্য এলাকার ১০০ জনকে রাখা হয়। তাঁদের প্রতি রাতে খিচুড়ি খাওয়াতে হয়েছে। এটা এবার পূজার বাড়তি খরচ। প্রতিবছর এখানে চাঁপাইনবাবগঞ্জের গম্ভীরা গানসহ সাংস্কৃতিক আয়োজন থাকে। এবার রাখা হয়নি। এমনটা ঘটল বহু বছর পর।

পূজা উপলক্ষে আয়োজিত মেলায় হরেক রকমের মিষ্টির পসরা সাজিয়ে বসেছিলেন আতাউর রহমান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এবার মেলায় মানুষের সমাগম কম। মিষ্টি বিক্রি হয়েছে গত বছরের তুলনায় প্রায় অর্ধেক।

চাঁপাইনবাবগঞ্জের ইতিহাস ও ঐতিহ্য–সম্পর্কিত একাধিক বইয়ের লেখক নবাবগঞ্জ সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ সৈয়দ মোজাহারুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, জেলার সবচেয়ে বড় ও বহু পুরোনো বারঘরিয়ার বাইশ পুতুলের দুর্গাপূজা। জেলা ও জেলার বাইরে থেকে হাজার হাজার মানুষ এ পূজা দেখতে আসে। আগে এখানে বিরাট মেলা বসত। ফাঁকা জায়গা ছিল অনেক। পূজা উপলক্ষে যাত্রাপালা ও নাটক মঞ্চস্থ হতো। অনেক বছর থেকে সেসব আর হয় না। ফাঁকা স্থানগুলোতে বাড়িঘর হয়ে যাওয়ায় মেলাও সংকুচিত হয়ে গেছে। এবার লোকসমাগম কম হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *