বেপরোয়া অপরাধীরা

দিনদিন ভয়ংকর হয়ে উঠেছে রাজধানীর অপরাধীরা। কেবল বাসা লুটপাটই নয়, লুটের পর বাচ্চা নিয়ে উধাও হয়ে যাওয়ার ঘটনাও এবার ঘটেছে। পুলিশের চোখ ফাঁকি দিতে নিত্যনতুন কৌশল নিয়ে এগোচ্ছে অপরাধীরা। চুরি করতে গিয়ে খুন করা হয় বাসার মালিককে। দিনদুপুরে ঘটছে ছিনতাইয়ের ঘটনা।

সংশ্লিষ্টরা বলছে, গত দুই মাস ধরে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার, মাদক কারবারি ও বিভিন্ন অপরাধীর বিরুদ্ধে সারা দেশে চলছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যৌথ অভিযান। এসব অপরাধীদের ঠেকাতে সম্প্রতি নিরাপত্তা জোরদারের পাশাপাশি অভিযানের গতি আরও বাড়ানো হয়েছে। তাতেও কাজ হচ্ছে না। নানান কায়দায় অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে।পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মো. ময়নুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আমরা চেকপোস্ট এবং প্যাট্রোলিং বাড়িয়েছি। আজকেও (শনিবার) ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ক্রাইম কনফারেন্সে অপরাধ নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। প্রতিটি ঘটনা যেন রেকর্ডেট থাকে, ওইসব ঘটনায় যেন দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হয় এবং যেসব ঘটনা ঘটে সেগুলো যেন উদঘাটিত হয়। আর এসব ঘটনায় পুরনো কিছু অপরাধী মাথাচাড়া দেয়, আবার নতুন নতুন অপরাধীও তৈরি হয়। তবে আমাদের দৃষ্টিতে অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আছে, কিন্তু আমরা আত্ম তুষ্টিতে ভুগছি না।

জানা গেছে, ঢাকা মহানগর এলাকায় ছিনতাই-ডাকাতি প্রতিরোধে পুলিশকে টহল দিতে ৩০০ মোটরসাইকেল দেওয়া হয়েছে। যৌথ অভিযানে কিছু এলাকায় ব্লক রেড ও কম্বিং অপারেশন (চিরুনি অভিযান) পরিচালনা করা হচ্ছে। এমন কঠোর অভিযানের মধ্যেও রাজধানীতে অপরাধীরা হয়ে উঠেছে ভয়ংকর বেপরোয়া। এ চিত্র কিছুটা অনুমান করা যায় বৃহস্পতি ও শুক্রবারের কয়েকটি ঘটনায়।

শুক্রবার সকালে রাজধানীর আজিমপুরে মেডিকেল স্টাফ কোয়ার্টারে একটি বাসায় লুট হয়। এ সময় বাসা থেকে টাকা ও স্বর্ণালংকার নেওয়ার পাশাপাশি আট মাসের একটি শিশুকে অপহরণ করা হয়।

এর আগে বৃহস্পতিবার কিশোর গ্যাং এর ৫-৬ জন সদস্য শান্ত (১৭) নামে এক তরুণকে ছুরিকাঘাত করে পালিয়ে যায়। পরে তাকে উদ্ধার করে মধ্যরাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। শুক্রবার সকালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়।

একইরাতে ধানমন্ডিতে একটি বাসায় যুক্তরাজ্য প্রবাসী এ কে এম আবদুর রশিদ (৮৫) নামে এক চিকিৎসক খুন হন। তিনি ও তার স্ত্রী সুফিয়া রশিদ যুক্তরাজ্য প্রবাসী। তারা দুজনই চিকিৎসক। গত সেপ্টেম্বরে দেশে আসেন তারা।  পুলিশের দাবি, ৫ আগস্টের পর থানায় থানায় পুলিশের বিভিন্ন পর্যায়ের সদস্যরা বদলি হয়েছে। বদলি হওয়া এসব সদস্য থানা এলাকায় অলিগলি চিনতে কিছু দিন সময় লেগেছে। এ ছাড়া তাদের সোর্সও ঠিকমতো গড়ে ওঠেনি। তাই মাঠপর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে তাদের বেগ পেতে হয়েছে। আর এ সুযোগে অপরাধীরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। কিছু এলাকায় গড়ে উঠেছে নতুন সন্ত্রাসী গ্রুপ। তবে এসব দুষ্কৃতকারী ও সন্ত্রাসীদের আইনের আওতায় আনতে এখন সক্ষম হচ্ছে তারা। এদিকে গত কয়েক দিন আগে মোহাম্মদপুরের বিভিন্ন এলাকায় ছিনতাই, ডাকাতি, সন্ত্রাসীসহ কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতা বেড়ে যাওয়ায় বাসিন্দাদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়।

পরে দুষ্কৃতকারীদের লাঘাম টানতে মোহাম্মদপুর এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

এমন অভিযানের মধ্যেও দিনদুপুরে গত ৫ নভেম্বর মোহাম্মদপুরের মোহাম্মদী হোমস আবাসিক এলাকার একটি বাসায় দুর্ধর্ষ চুরির ঘটনা ঘটে। ওই এলাকার মাহমুদা ইসলাম ভিলা নামের একটি ভবনে বোরকা পরে নারী সেজে চার ফ্ল্যাটের স্বর্ণালংকার ও নগদ টাকা লুট করে নিয়ে যায়। সূত্র জানায়, এ বিষয়ে ঘটনার দিন ডিএমপির মোহাম্মদপুর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন ভবনটির মালিক বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের সাবেক পরিচালক নুরুল ইসলাম মিঞা। এর আগের দিন ৪ নভেম্বর রাজধানীর গেন্ডারিয়া ডিআইটি প্লট এলাকার সতীশ সরকার রোডের একটি বাসায় দুপুর ১২টায় একই ধরনের ঘটনা ঘটে। ছয় তলা ভবনের তিন তলার একটি ফ্ল্যাটের তালা ভেঙে স্বর্ণালংকার ও নগদ টাকা লুট করে নিয়ে যায়।

ভুক্তভোগী সুমন হোসেন বলেন, আমরা স্বামী-স্ত্রী সকালে অফিসের কাজে বের হই। ফিরে এসে দেখি ঘরের তালা ভাঙা ও ভিতরে সবকিছু এলোমেলোভাবে পড়ে আছে। পরে বুঝতে পারি বাসায় চুরি হয়েছে। দুর্বৃত্তরা নগদ টাকা ও স্বর্ণালংকারসহ তার সাড়ে তিন লাখ টাকা নিয়ে গেছে। অক্টোবরে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্পে চারজন খুন হন। এরপরই ছিনতাই, ডাকাতি, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে মোহাম্মদপুর থেকে ৩৪ জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

জানতে চাইলে ডিএমপির তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মোহাম্মদ রুহুল কবীর খান বলেন, মোহাম্মদপুরে আগে থেকেই অপরাধীরা বেপরোয়া ছিল।

গত কয়েক দিন আগে যেসব ঘটনা ঘটেছে সেগুলোর ব্যাপারে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে এবং ডিটেকশনও হয়েছে। বিগত দিনের তুলনায় মোহাম্মদপুর এলাকা এখন অনেক ভালো।

ডিএমপি সূত্র জানায়, কমিশনার মো. মাইনুল হাসানের নির্দেশে মহানগরীর আইনশৃঙ্খলা রক্ষা, অবৈধ অস্ত্র, মাদক, অবৈধ মালামাল উদ্ধার ও ছিনতাই প্রতিরোধে মহানগরীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ও কৌশলগত স্থানে নিরাপত্তামূলক বিশেষ চেকপোস্ট কার্যক্রম শুরু হয়েছে।

মোহাম্মদপুরের বসিলা, কোতোয়ালির বাবুবাজার, শ্যামপুরের পোস্তগোলা ব্রিজ, যাত্রাবাড়ীর সাইনবোর্ড, ডেমরার স্টাফ কোয়ার্টার, সবুজবাগের বাসাবো রাস্তায় (কমলাপুর), দারুস সালামের গাবতলী, খিলক্ষেতের ৩০০ ফিট, উত্তরার আবদুল্লাহপুর ব্রিজ ও কামারপাড়া এবং তুরাগের ধৌড় ব্রিজ নামক স্থানে ডিএমপির বিশেষ এ চেকপোস্ট কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। প্রতিদিন দুটি পালায় এ বিশেষ চেকপোস্ট কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। প্রথম পালা বিকাল ৪টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত এবং দ্বিতীয় পালা রাত ১২টা থেকে সকাল ৮টা পর্যন্ত পরিচালনা করা হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *